শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

সমুদ্রপথে ফেরি চলাচলের যুগে বাংলাদেশ

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

সমুদ্রপথে প্রথম ফেরি চলাচলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। ট্রলার ও স্পিডবোটের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার অবসান ঘটিয়ে সোমবার (২৪ মার্চ) সকাল থেকে চালু হলো চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ও জীবনযাত্রায় নতুন দিগন্তের সূচনা হলো দ্বীপবাসীর জন্য।

নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে এই ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করেন। এরপর সকাল ৯টায় বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ২০টি যানবাহন ও উপদেষ্টাদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ফেরি ছেড়ে যায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ার উদ্দেশে। প্রায় এক ঘণ্টা ১৬ মিনিট যাত্রার পর ফেরিটি গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছে।


বিজ্ঞাপন


উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন—অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সন্দ্বীপের সন্তান মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বক্স চৌধুরী ও অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানও তাদের সঙ্গে ছিলেন।

যারা ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এমনকি ফেরি উদ্বোধন উপলক্ষে দুপুরে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত সমাবেশেও উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্যে বলেন, সন্দ্বীপ দেশের অন্যতম উপকূলীয় দ্বীপ। কিন্তু ৫০ বছরের মধ্যে কেন নিরাপদ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি, কী লজ্জার কথা! সন্দ্বীপের মানুষ এতদিন কাদা মাড়িয়ে ডিঙি নৌকা আর বোটে করে সমুদ্র পারাপার করতে হয়েছে। সন্দ্বীপের সাথে আজ নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। কেন এতদিন হয়নি, সেটা লজ্জার। এ লজ্জা থেকে বাঁচলাম। কলঙ্ক থেকে আজ মুক্ত হলাম।


বিজ্ঞাপন


সমাবেশে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই ফলপ্রসূ হবে না যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ উন্নত না হয়। এখানে ফেরি চলাচলের আগে নৌঘাট দখলমুক্ত করতে হয়েছে। সমুদ্র উপকূল হওয়ায় ফেরি চালু করা দুরূহ ছিল। দুটি ঘাটের নাম কাল থেকে জুলাই আন্দোলনে সন্দ্বীপের শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকত ও সাইমুন হোসেন মাহিনের নামে নামকরণের প্রস্তাব করছি।

সন্দ্বীপের সন্তান সড়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এই ফেরি চালুর মূল কৃতিত্ব আমাদের প্রধান উপদেষ্টার। গত আগস্টে প্রথম উনাকে মহিলাদের কাদা মাটি পেরিয়ে পারাপারের কথা বলি। তিনি বলেছেন, এটা হতে পারে না। অবশ্যই সমাধান করতে হবে। এটি একটি দুরূহ প্রকল্প কারণ বাংলাদেশে সামুদ্রিক ফেরি চলাচলের অভিজ্ঞতা নেই।

আরও পড়ুন—

আর এই ফেরি সার্ভিস সমুদ্রপথে দেশে প্রথম এবং সন্দ্বীপবাসীর স্বপ্নপূরণ বলে আখ্যায়িত করছেন চট্টগ্রামের বিআইডব্লিউটিএ এর উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান। তিনি জানান, চট্টগ্রাম শহরের প্রায় নিকটবর্তী হলেও উত্তাল সমুদ্রের কারণে সন্দ্বীপ উপজেলাটি ছিল বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। প্রতিদিন এই দ্বীপের হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রপথে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন।

বৈরী আবহাওয়ায় দ্বীপটি প্রায়ই মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, যার ফলে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম শহরে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। প্রায় চার লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত সন্দ্বীপ উপজেলার মানুষের শত বছরের বড় দুর্ভোগের অবসান ঘটল ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে।

তিনি জানান, অন্তত ৩৫টি যানবাহন নিয়ে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপের মধ্যে বিশেষ এই ফেরিটি চলাচল করতে সক্ষম। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে ফেরি পৌঁছাবে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিদিন মোট চারবার ফেরিটি আসা-যাওয়া করবে। ফেরিটি যানবাহনের পাশাপাশি অন্তত ৬০০ জন মানুষ পরিবহন করতে পারবে।

এই সার্ভিস চালুর পাশাপাশি ঢাকা-সন্দ্বীপ রুটে বিআরটিসির বাস সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট-সি বিচ-নিমতলা-বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট-সন্দ্বীপ এনাম নাহার মোড় রুটে এসি বাস পরিষেবা শুরু হয়েছে। ফলে সন্দ্বীপের মানুষ সহজেই রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে।

ফেরিতে যাতায়াতের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে- সাধারণ যাত্রী ১০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৯০০ টাকা, বাস ৩ হাজার ৩০০ টাকা, ট্রাক ৩ হাজার ৩৫০ টাকা, ১০ চাকার গাড়ি ৭ হাজার ১০০ টাকা। ফেরি ও বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্বীপবাসীর জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিআইডব্লিউটিএ এর উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান।

সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, ফেরি সার্ভিস চালুর পথে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকে। কিন্তু তিনি সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সফলভাবে চার লাখ সন্দ্বীপবাসীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। সন্দ্বীপের সন্তান হওয়ায় এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছেন তিনি।

এর আগে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান একাধিকবার সন্দ্বীপ পরিদর্শন করে প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ দ্বীপ আমার জন্মস্থান। আমার দায়বদ্ধতা আছে। সন্দ্বীপ অনেক দিক থেকে পিছিয়ে আছে। দ্বীপবাসীর যাতায়াত সমস্যা দূর করতে পেরে আমি আনন্দিত।

স্থানীয়রা জানান, বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত সন্দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বরাবরই ছিল কষ্টসাধ্য। বর্ষাকালে উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠত। এ পর্যন্ত বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে স্পিডবোট ডুবে প্রাণ হারান চারজন।

আরও পড়ুন—

ss-h

দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ নৌযান চালুর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল আমরা সন্দ্বীপবাসীসহ বিভিন্ন সংগঠন। ২০১২ সালে নির্মিত জেটি অব্যবহৃত থাকলেও, ২০২২ সালে সরকার ফেরি সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে তা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়।

ফেরি সার্ভিস চালুর মাধ্যমে সন্দ্বীপের মানুষের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হলো। এ উদ্যোগ সন্দ্বীপকে অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন আমরা সন্দ্বীপবাসী সংগঠনের সমন্বয়ক মাহবুবুল মাওলা।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন