চলছে পবিত্র মাহে রমজান মাস। প্রতিবারের মতো রমজান মাসে এবারও টাঙ্গাইলের মধুপুরের ‘জিআই’ পণ্য আনারসের কদর বেড়েছে। বর্তমানে হাট-বাজারে যেসব আনারস পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই জলডুগি আনারস। প্রান্তিক পর্যায়ের আনারস চাষিরা আশানুরূপ দাম না পেলেও পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দামে আনারস বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ চাষি ও সাধারণ ক্রেতাদের।
অপরদিকে, অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় মধুপুর উপজেলার পাহাড়ি চরাঞ্চলের আনারস বাগানগুলোতে দেদারসে প্রয়োগ করা হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক। এতে দ্রুত আনারসের ফলন বৃদ্ধি পেলেও আতঙ্কে দিন দিন এর চাহিদা কমে যাচ্ছে দেশজুড়ে। ফলে মধুপুর হারাচ্ছে আনারসের অতীত ঐতিহ্য। লোভনীয় ও রসালো এই আনারস খেয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন ক্রেতারা।
বিজ্ঞাপন
মধুপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, জেলার পাহাড়ি জনপদ মধুপুরে চলতি মৌসুমে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের রসালো ও সুস্বাদু আনারস আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ক্যালেন্ডার, জলডুগি ও এমডি-২ জাতের আনারস বেশি চাষ রয়েছে। চলমান সময়ে জলডুগি আনারস বাজারজাত করছেন চাষিরা। মধুপুরে চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমিতে জলডুগি আনারস আবাদ হয়েছে।
গারো সম্প্রদায়ের অজয় এ.মৃ বলেন, মধুপুর পাহাড়ি বনাঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের লোকজন আনারস চাষ শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে এ অঞ্চলে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন আনারস চাষ শুরু করেন। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ আনারসের সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মধুপুরের আনারস নিজ জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় আনারস বিক্রি করছে কৃষকরা।
বিজ্ঞাপন
আনারস চাষিরা জানায়, আনারসের চারা রোপণের পর থেকে দ্রুত ফল আসা, ফল বড় করা, দ্রুত ফল পাকানো ও রং আকর্ষণীয় করতে আনারস বড় করতে প্রানোফিক্স, সুপারফিক্সসহ বিভিন্ন রাসায়নিক কয়েক ধাপে দেওয়া হয়। সাধারণত গাছে ৬০টি পাতা হওয়ার পর আনারস ধরে। কিন্তু ২৮টি পাতা হওয়ার পরেই ফল ধরার জন্য রাইপেন, ইথোফন, জিব্রেলিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দেওয়া হয়।
সরেজমিনে মধুপুর উপজেলার ভবানীটেকী, গায়োবাজার, ইদিলপুর, মোটের বাজার, কাইলাকুড়ি, হাগুড়াকুড়ি, শোলাকুড়ি, ঘুঘুর বাজার, পঁচিশ মাইল, পীরগাছা, জাঙ্গালিয়া, জলছত্র ও গায়রা গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাগানেই দেখা যায় ক্ষেতের মালিক ও শ্রমিকরা আনারসে রাসায়নিক স্প্রে করছেন। তারা বেশি লাভের আশায় দ্রুত সময়ে আনারস বড় করা হচ্ছে এবং অপরিপক্ব আনারস দ্রুত পাকাচ্ছে।
পাহাড়ি অঞ্চলের পীরগাছা গ্রামের আসারস চাষি আক্কাস আলী জানান, আনারস গাছে কোনো দিনই একসঙ্গে সব গাছে ফল ধরবে না। কিছুকিছু গাছে ফল ধরবে আর পাকবে। আর কেমিক্যাল দিলে আনারস একসঙ্গে পেকে যায়। কেমিক্যাল দেওয়ার কারণে শিয়াল, বানর, টগা, কটাবানরেও আনারস এখন খায় না। মধুপুরের মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিলেও দেশের মানুষ ঠিকই কিনে খাচ্ছে।
কৃষক হারুন অর রশিদ জানান, দ্রুত ফল ধরা এবং ফল বড় হওয়ার জন্য ১০ লিটার পানিতে ২ থেকে ৩ মিলিলিটার রাসায়নিক ব্যবহারের কথা বলা হয়। তবে, কোনো কোনো কৃষক ১০ লিটার পানিতে ২ থেকে ৩ মিলিলিটারের স্থলে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পর্যন্ত রাসায়নিক মিশিয়ে আনারসে ছিটান। এতে আনারস দ্রুত পেকে যায় ও রং সুন্দর হয় এবং একসঙ্গে পুরো জমির আনারস বাজারজাত করা যায়।
রানিয়াদ গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল বারেক জানান, রমজানের আগে আনারস বাগান কেনা হয়। ক্রেতারা বড় এবং ভালো রঙের আনারস পছন্দ করেন। তাই বাধ্য হয়ে রাসায়নিক ব্যবহার করি। এতে অল্প সময়ে লাভ বেশি হয়। বিভিন্ন সার ও কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসব রাসায়নিক সরবরাহ করছে। এসব রাসায়নিকের বোতলের গায়ে পাকানোর জন্য ব্যবহারের নিয়ম লেখা থাকে না।
তিনি আরও জানান, আগে আনারসের বাগানে আসলে অনেক ঘ্রাণ পেতাম। মধুপুরের আনারস মিষ্টি ও সুস্বাদু ছিল। বর্তমানে শিয়াল, কটা বানর, টগা, বানর, এরাও এখন আনারস খায় না। বিভিন্ন মেডিসিন দেওয়ার ফলে বাগানের আশপাশে মানুষও আসে না। অনেকে খেতেও চায় না। এতে বাজারে এবার ভালো দাম পাচ্ছি না। কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা হাট-বাজারগুলো বেশি দামে বিক্রি করছে।
ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কৃষিবিদ আব্দুল লতিফ তালুকদার বলেন, অসময়ে আনারস চাষে যে পরিমাণ রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে তাতে মানবদেহের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে। বিশেষ করে কিডনি ও লিভারে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই অসময়ে আনারস না খাওয়াই উত্তম।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যটি ‘জিআই’ পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে সে হিসেবে এই পণ্যের অর্থাৎ আনারসের গুণগতমান, বাজারজাতকরণ ও চাষাবাদ এসব কৃষি বিভাগের ওপর নির্ভর করে। তাই কৃষি বিভাগকে আরও কার্যত হতে হবে। যাতে কৃষকরা রাসায়নিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার সুযোগ নিতে পারবে না।
উপজেলা কৃষি অফিসার রাকিব আল রানা বলেন, মধুপুরের আনারস রসালো ও সুস্বাদু। বর্তমানে ক্যালেন্ডার, জলডুগি ও এমডি-২, জাতের আনারস আবাদ হচ্ছে। অনেকে আনারস পাকানোর ওষুধ ব্যবহার করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আমরা কৃষকদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। যাতে করে তারা রাসায়নিক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করে। আমরা বিভিন্ন ওষুধের দোকান মনিটরিং করছি।
প্রতিনিধি/এসএস