নড়াইল সদর উপজেলার শোলপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. হাদিউজ্জামান। এক সময় কৃষি কাজ করে সংসার চালাতেন। কৃষি কাজে তেমন লাভ না হওয়ায় বন্ধুর পরামর্শে পাঁচ বছর আগে শুরু করেন বর্ষা মৌসুমে হাঁসের খামার। প্রথম বছরে মাত্র ২০০ হাঁস দিয়ে খামার শুরু করেন। লাভ ভালো হওয়ায় প্রতি বছর খামারে হাঁসের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। এবছরও এই খামারি হাঁস পালন করছেন। বর্তমানে তার খামারে হাঁসের সংখ্যা ৫০০। প্রতিদিন এই খামার থেকে অন্তত ৪০০ ডিম উৎপাদন হচ্ছে। চলতি মৌসুমে ছয় মাস খামার পরিচালনা করে অন্তত ৩ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।
নড়াইলে বিলের পানিতে বছরে ছয় মাস হাঁস পালন করে বেকারত্ব ঘুচাচ্ছেন বেকার যুবকেরা। প্রতি বছর মৌসুমি এসব খামামিরা মাত্র ছয় মাস হাঁস পালন করে ইনকাম করছেন ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলের পানিতে হাঁস পালন করতে পারায় এবং অল্প খরচে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভ হওয়ায় প্রতি বছর খামারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমন ডিম উৎপাদনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলায় প্রতি বছর সাড়ে ৩ কোটি হাঁসের ডিম উৎপাদনের মধ্যে অন্তত দেড় কোটি ডিম উৎপাদন করছে এ জনপদের বিল অঞ্চলের মৌসুম খামারিরা।
বিজ্ঞাপন
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, প্রতিবছর নড়াইল থেকে সাড়ে ৩ কোটি হাঁসের ডিম উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য অন্তত ৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেড় কোটিরও বেশি ডিম উৎপাদন হয় বিলের পানিতে ছয় মাস হাঁস পালন করে। ছয় মাসের এই সিজনে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলের পানিতে হাঁস পালন করে অন্তত ২৫ কোটি টাকার ডিম উৎপাদন করে বিল অঞ্চলের হাঁস মালিক ও কৃষকেরা।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, ৯৬৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কৃষি প্রধান জেলা নড়াইল। প্রায় ৮ লাখ মানুষের বসবাসের এ জেলা বিল ও ঘের বেষ্টিত অঞ্চলে। এ জনপদের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস কৃষি কাজ ও মৎস্য চাষ। জেলায় তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় এ জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। বিসিক শিল্প নগরী বিহীন এ জেলায় ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো উদ্যোগতা গড়ে উঠেনি। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে নিজ নিজ উদ্যোগে অন্তত দেড়শ কৃষক ও যুবক বর্ষা মৌসুমে অস্থায়ী খামার করে হাঁস পালন করছেন।
বিজ্ঞাপন
কৃষক ও খামারিরা জানান, জেলার লোহাগড়া, কালিয়া এবং সদর উপজেলার শোলপুর বিল, ইছামতি বিল, কলোড়ার বিল, দুধপাতলের বিল, পাটেরশরী বিলসহ বারটি বিলের আশপাশের গ্রামের অন্তত দেড়শ কৃষক ও যুবকেরা অস্থায়ী খামার করে হাঁস পালন করছেন। প্রতিদিন সকালে খোঁলা আকাশের নিচে দিগন্তজোড়া বিলের মধ্যে হাঁস ছেড়ে দেন খামারিরা। সারাদিন বিলের পানিতে দল বেধে ঘুরে বেড়ায় হাঁস। বিলে থাকা প্রাকৃতিক খাবার খায় আর বিল ভরা পানিতে মনের আনন্দে দল বেধে খেলা করে হাঁস। সারাদিন পানিতে ছোটাছুটি করে সন্ধ্যার আগে এক সঙ্গে আবার ঘরে ফেরে প্রতিটা খামারের হাঁস।
শোলপুর গ্রামের খামারি মো. জিহাদ বলেন, প্রতিবেশী বড় ভাইদের দেখে তিন বছর আগে ২০০ হাঁস নিয়ে খামার শুরু করেছিলাম, প্রথম বছর থেকে লাভ ভালো হচ্ছে। এজন্য প্রতি বছর খামারে হাসের সংখ্যা বাড়িয়েছি। বর্তমানে খামারে হাঁসের সংখ্যা ১ হাজার। আশা করছি এবছর পাঁচ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভ হবে।
খামারি শাহীন বলেন, বছরে একটানা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ডিম দেয় এ হাঁস। প্রতিদিন সকাল বেলা খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি পিস ডিম ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন হাঁস মালিকরা। হাঁস পালন করে এলাকার খামারি ও হাঁস মালিকদের পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা। আর প্রতি বছর এ জনপদে খামারের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন হাঁস প্রেমীরা।
লোহাগড়া উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের খামারি তজিবর শেখ বলেন, বিলের পানিতে হাঁস পালন করলে হাঁস প্রাকৃতিক খাবার খায় ফলে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয় এবং লাভ বেশি হয়।
একই এলাকার রেজাউল ইসলাম বলেন, বিল অঞ্চলের প্রতিটা খামারে রয়েছে ২০০ থেকে দুই হাজারটি পর্যন্ত ক্যাম্বেল হাঁস। অস্থায়ী খামার ছাড়াও বিল এলাকার প্রতিটি বাড়িতে এই সময় হাঁস পালন করেন পরিবারের সদস্যরা।
নড়াইল জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. সিদ্দীকুর রহমান বলেন, বিল এলাকায় হাঁস পালন করলে খামারিরা বেশি লাভবান হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে বিলের পানিতে হাঁস ছেড়ে দিলে বিলের খাবার খায় ফলে খামারিদের হাঁসের খাবারের জন্য বাড়তি পয়সার প্রয়োজন হয় না। ফলে খামারিরা বেশি লাভবান হয়। হাঁসের মাংস ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খামারিদের প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহযোগিতা ও ভ্যাকসিনসহ বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা করা হয়।
প্রতিনিধি/এসএস