বাপু, আটাশিতেও বানের এমন জোর ছিল না। সেসময়ও আমগোর এদিকে এতো পানি উঠে নাই, এবার হুট করে পানি আসায় সব ডুবে গেছে। এহন আমার গরুগুলো সড়কে রাখছি। হাঁস-মুরগি বানের পানিতে বাইসসা গেছে গা। কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইগাতী উপজেলার সদর ইউনিয়নের দিঘিরপাড়ের সত্তরোর্ধ্ব জুলহাস আলী।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের সব পাহাড়ি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে এবং উপচে প্লাবিত হয়েছে জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীর অন্তত ১৬টি ইউনিয়ন। আকস্মিক এ বন্যায় এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পানিবন্দী অবস্থায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ।
বিজ্ঞাপন
নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ভারী বর্ষণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন ইদ্রিস আলী, খলিলুর রহমান ও বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের ওমিজা বেগমসহ চার জন। নিখোঁজ রয়েছেন একজন। সেনাবাহিনী, পুলিশ ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান চললেও পানির প্রবল স্রোত আর পর্যাপ্ত নৌযানের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কাজ।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার এবং নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির তীব্র স্রোতে অপর পাহাড়ি নদী চেল্লাখালীর ওয়াটার গেজ উঠে যাওয়ায় এখানকার পরিমাপ জানা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়াও অপর দুটি পাহাড়ি নদী মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী ও দশানী নদীর পানি। তবে পাহাড়ি নদীগুলোর উজানে নদীর পানি কিছুটা কমলেও থেমে থেমে ভারী বর্ষণের ফলে তেমন উন্নতি হচ্ছে না। বরং ভাটি এলাকায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাটি অঞ্চলে গিয়ে বন্যার তীব্রতা বেড়েছে।
শুক্রবার রাত থেকে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালে, সিলিংয়ে ও মাচায়।
বিজ্ঞাপন
নালিতাবাড়ীর ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর ও ঝিনাইগাতীর মহারশির বিভিন্ন স্থানের বাঁধে ব্যাপক ভাঙন হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া গাজিরখামার সড়ক, শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া তিনআনী সড়ক, নালিতাবাড়ী-নাকুগাঁও স্থলবন্দর সড়কসহ জেলার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১০টি সড়ক। বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য গ্রামীণ পাকা ও কাঁচা সড়ক। ভেসে গেছে এসব এলাকার সব পুকুরের মাছ। সেইসঙ্গে কারও কারও গবাদি পশু ভেসে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে উঠতি আমনের খেত। বিভিন্ন স্থানে বানের পানিতে ধসে ও ভেসে গেছে কাঁচা ঘর-বাড়ি। পানিতে ভাসছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। এসব এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তা অপর্যাপ্ত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেকে আসতে পারছেন না।
বানবাসি নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীর একাধিক লোকজন জানান, গত ৩০-৩৫ বছরেও এমন ঢলের পানি দেখেনি তারা। এবার পানিতে ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে।
জেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত জেলার সাড়ে ৩৬ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমির আমন ধানের আবাদ পানিতে তলিয়ে গেছে। ৯২৬ হেক্টর জমির সবজির আবাদ পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে শেরপুরে ৩৭ মিলিমিটার এবং নালিতাবাড়ীর দুটি পয়েন্টে ১৭০ ও ১০০ মিলিমিটার।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ হতে বানবাসিদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করছে।
শনিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরের দিকে বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। তারা নানানভাবে সহযোগিতা করছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, পাহাড়ি ঢলে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ৮টি ইউনিয়নে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতায় ৩৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় সাত হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার তরফ থেকে ৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৫ হাজার পরিবারের মাঝে শুকনা খাবারের প্যাকেট ও খাওয়ার পানি দেওয়া হয়েছে। পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার ও ত্রাণকাজ পরিচালনায় ১২ ইউনিয়নের জন্য আলাদা করে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে।
প্রতিনিধি/এসএস