সম্প্রতি সারাদেশে রাসেলস ভাইপার সাপের তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘উলুবোড়া’ নামে পরিচিত সাপটিই মূলত রাসেলস ভাইপার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিষয়টি নিয়ে অনেকে নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকে প্রচার করছেন যে সাপটি কামড় দিলে দ্রুত মৃত্যু হয়।
মূলত সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি জেলায় রাসেলস ভাইপারের কামড়ে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়াতে সাহায্য করেছে। মানুষ ভাবতে শুরু করেছে এই সাপে কামড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু। অনেকে না জেনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। এর যে চিকিৎসা আছে এবং চিকিৎসা নিলে যে ভালো হওয়া যায় সেটা বেশির ভাগের অজানা বলেই আতঙ্ক মাত্রা ছাড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অনেকে বলছেন, রাসেলস ভাইপার খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে। ফলে সহসা দেশের গ্রামাঞ্চলে এই সাপের আধিক্য মানুষের জন্য হুমকি তৈরি করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার নিয়ে যে মাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে তা কতটা যৌক্তিক? এ ব্যাপারে সাভারের বেদে পল্লীর একাধিক বেদে সর্দারের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই সাপটি বিষধর হলেও এর কামড়ে নির্ঘাত মৃত্যু এই কথাটি সত্য নয়। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার একেবারেই কম বরং রাসেলস ভাইপারের চেয়েও আরও বিষধর সাপ বাংলাদেশে রয়েছে। আর এই সাপটিকে বিভিন্ন মাধ্যমে যেভাবে ভয়ংকর আক্রমণাত্মক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। মূলত এই সাপটি খুবই অলস প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই সাপ কখনোই কাউকে তেড়ে এসে কামড় দেয় না। এটি সাধারণত রাতে চলাচল করতে পছন্দ করে। ঘাস বন, ঝোপ ঝাড়, ফসলের গোলা কিংবা জমির বড় গর্ত এদের পছন্দ। সাধারণত এরা বাড়িতে থাকে না। তাই রাতে চলাচলে সতর্ক হতে হবে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সাপুরে সরদার রঙ্গু মিয়া বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপ কাওকে কামড় দিলে কোন ওঝা বা কবিরাজের কাছে না গিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। কারণ সঠিক সময়ে অ্যান্টিভেনম গ্রহণ করলে এই সাপের বিষ থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
বিজ্ঞাপন
আরেক সাপুরে স্বপন সরদার বলেন, আমরা ছোট থেকেই সাপ নিয়ে চলাফেরা করি। সাপের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। ইদানিং শুনতেছি রাসেলস ভাইপার নামে এক সাপ নিয়ে মানুষ অনেক আতঙ্কিত। তবে এই সাপটির নাম মূলত চন্দ্রবোড়া। এটি অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে বসবাস করে। এটা খুব শান্ত ধরনের সাপ। কেও বিরক্ত না করলে এটা কাওকে কামড়ায় না। আর এই সাপের বিষের ওষুধও আছে।
সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বেদে পল্লীর বাসিন্দা মো. রমজান আহমেদ বলেন, সারাদেশের সবাই রাসেলস ভাইপারের কারণে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। আমাদের এই এলাকাটি বংশী নদী তীরবর্তী এবং এখানে প্রায় ১৫ হাজার বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস কিন্তু এখানে কারো মধ্যেই এই সাপ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে না। তাদের দাবি, এই সাপটি বিষধর হলেও এটি ভয়ংকর কোনকিছু নয়। আর আমাদের সরকারি হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিভেনম রয়েছে। তাই আমি সকলকে বলবো, রাসেলস ভাইপারসহ যেকোনো বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে যেভাবে আতঙ্কের কথা ছড়াচ্ছে সেটি মূলত ভয় এবং অপর্যাপ্ত জ্ঞান থেকে। তাই পর্যাপ্ত তথ্যসহ এর বিস্তার, কামড়ালে করণীয় ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে সকলকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, কোনো সাপই কখনো কাউকে তেড়ে এসে কামড় দেয় না। সাপ যখন নিজে হুমকির শিকার হয় তখনই সে ছোবল দেয়। রাসেল ভাইপারের ক্ষেত্রেও তাই। এদের গায়ের রঙ ধুসর হওয়াতে এরা মাটির সঙ্গে অনেকটা মিশে থাকে। যার ফলে হঠাৎ করে মানুষজন তার খুব কাছাকাছি চলে যায়, আর তখনই সে কামড় দেয়। আর এই সাপ বিপদ দেখলে প্রথমে ফোঁসফোঁস শব্দ করে তাই এমন শব্দ শুনলেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। এই সাপ মূলত ইঁদুর ও ফসলের নানা রকম ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে থাকে এতে ফসলের যেমন উপকার হয় পাশাপাশি এর বিষ থেকেও অনেক জীবনরক্ষকারী ওষুধ তৈরি হয়। যার ফলে রাসেল ভাইপার যদি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায় তাহলে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাবে। আর সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিতে পারলে রাসেল ভাইপারের কামড়ের রোগীও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারলে এ সাপের কামড়ে মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে। তবে সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যু হতে পারে।
এ বিষয়ে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদা ঢাকা মেইলকে বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে খুব বেশি নড়াচড়া না করে তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আর এই সাপের বিষ হলো হেমোটক্সিন তাই এ সাপ কামড়ালে আক্রান্ত স্থানে কোনো গিঁট বা বাঁধন দেওয়া যাবে না। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। আর এখন পর্যন্ত সাভারে কোনো রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রুগীর খবর পাওয়া যায়নি। এর পরেও আমাদের সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিভেনম ও সাপের কামড়ের অন্যান্য ওষুধের মজুদ রয়েছে।
প্রতিনিধি/টিবি