রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বহু আন্দোলনের সাক্ষী খুলনা মহানগরীর শহীদ হাদিস পার্ক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তান আমলে খুলনার বেশিরভাগ আন্দোলন-সংগ্রাম আবর্তিত হয়েছিল এই পার্কটি ঘিরে।
১৮৮২ সালে খুলনাকে জেলা শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার দুবছর পর গঠিত হয় পৌরসভা। ওই সময় শহরে একটি পার্কের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে বিশ শতকের শুরুতেই পৌরসভার সামনে এবং রাস্তার অপর পাশে কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। শুরু হয় পার্কের নির্মাণকাজ। পার্কটির নাম দেওয়া হয় মিউনিসিপ্যাল পার্ক।
বিজ্ঞাপন
১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী বরিশাল থেকে কলকাতা ফেরার সময় নৌপথে খুলনায় আসেন। মহাত্মা গান্ধী তখন ভাষণ দেন এ পার্কে। সেই থেকে এই পার্কের নাম হয়ে যায় গান্ধী পার্ক।
১৯৪০ সালে এখানে ভাষণ দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ওই সময় এ পার্কের নামে আসে পরিবর্তন। নাম হয় শহীদ পার্ক।
২০১৪ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে এখানে নবনির্মিত শহীদ মিনারের উদ্বোধন করা হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটি বড় প্রকল্পের আওতায় ঐতিহাসিক এই পার্কের আধুনিকায়ন করা হয়।
১৯৪৭। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান, ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম আর ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভ। খুলনাতেও উড়তে থাকে ভারতীয় পতাকা। তবে ১৮ আগস্ট গভীর রাতে এই অঞ্চলের মুসলিম নেতারা কলকাতা থেকে রেলগাড়িতে খুলনায় ফিরে জানান, কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বৃহত্তর খুলনা জেলা হবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। এ সময় তাদেরকে এই পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পার্কের নতুন নামকরণ করা হয় জিন্নাহ পার্ক।
এরপর পাকিস্তানের প্রতি বাংলার জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয় পড়লে ষাটের দশকে খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্ক নামটিই আবার ফিরে আসে।
বিজ্ঞাপন
১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনের বড় একটা ঢেউ লাগে খুলনাতে। উনসত্তরের রক্তবীজ বইতে খুলনার সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী লিখেছেন, ঊনসত্তরের ২১ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের সময় হাদিসুর রহমান, প্রদীপ ও আলতাফ এই তিনজন শহীদ হলে খুলনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। শহরে কারফিউ আর সান্ধ্য আইনের কারণে কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারছিলেন না ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে এক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ছাত্রনেতা লিয়াকত আলী (সাংবাদিক আলহাজ্ব লিয়াকত আলী) আর হুমায়ুন কবীর (সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালূ) মিউনিসিপ্যাল পার্কের কোনায় তৎকালীন সরকার সুইটস নামে একটি মিষ্টান্ন ভান্ডারে মিলিত হন। শহীদ হাদিসের নাম অমর করে রাখতে সিদ্ধান্ত হয় তাঁর নামেই পার্কটির নামকরণ করার। এসময় হুমায়ুন কবীর ২৫ পয়সার গুড়ো রং এবং ৫ পয়সা দিয়ে একটা সাদা কাগজ কেনেন। লিয়াকত আলী কাগজে শহীদ হাদিস পার্ক নামটি লেখেন।
এরইমধ্যে অন্য নেতারা পার্কের ভেতরে জড়ো হন, মই জোগাড় করে আঠা দিয়ে পার্কের মাঝের সাদা ঘরের ওপর কাজটি লাগিয়ে দেন। পরে ছাত্রনেতা শ্যামল সিংহ রায়ের বাড়িতে ছাত্রনেতা ওয়াহেদুজ্জামানের সভাপতিত্বে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চল্লিশ মিনিটের বৈঠকে নামকরণের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই বছরেই খুলনা সফরে এসে শহীদ হাদিসের কবরে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। ১৯৬৯ সালেই ছাত্রনেতারা শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ মিনার স্থাপনের কথা ভাবেন।
খুলনার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক খালেদ রশীদ গুরুকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটি অনুমতি পেতে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। এই কমিটির সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ কান্তি সরকারের ড্রয়িং অনুযায়ী জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে শহীদ মিনার নির্মিত হয়।
খুলনার ইতিহাস গবেষক ও শহীদ হাদিস স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জামাল উদ্দীন জানান, মহাত্মা গান্ধী, শেরেবাংলা এ কে ফজলু হক, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদচিহ্ন রয়েছে এই পার্কে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সকালে এই পার্কের শহীদ মিনারের সামনে খুলনার আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। আর ২০১৪ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে এখানে নবনির্মিত শহীদ মিনারের উদ্বোধন করা হয়।
২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটি বড় প্রকল্পের আওতায় ঐতিহাসিক এই পার্কের আধুনিকায়ন করা হয়।
এএ