‘আমরা এখন আছি গেম ঘরে। আগামী বুধবার আমাদের ডিঙ্গিতে তোলা হবে। এরপর চলে যাব ইতালিতে। আমার জন্য দোয়া করো। ইতালি গিয়ে তোমার সাথে কথা হবে- এরপর অপর প্রান্ত থেকে কেটে যায় কল। আর কথা হয়নি। ১৭ দিন পর খবর পেলাম সাগরে নিখোঁজ আমার স্বামী।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলেছিল ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হওয়া নরসিংদীর রবিউলের স্ত্রী সাথী আক্তার।
বিজ্ঞাপন
রবিউলের মতো এমন আরও ছয়জন নিখোঁজ হয়েছেন লিবিয়া হয়ে স্বপ্নের ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়।
বুকের ধন হারিয়ে স্বজনরা কেঁদে কেঁদে দিশেহারা প্রায়। খাবার দাবার ছেড়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে জ্ঞান হারাচ্ছেন সন্তান হারানো রফিকুল ইসলাম। মাটি থাপড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত শরীরে ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস। একই চিত্র প্রত্যেক নিখোঁজ যুবকের বাড়িতে।
ছেলে মনির হোসেনের নিখোঁজের সংবাদে নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন তার বাবা হারুন রশিদ। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, পরিবারের সুখের চিন্তা করে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে আমার ছেলে বিদেশ গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল একবার যেতে পারলে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে ছেলের বিদেশের জন্য টাকা দিয়েছি। এখন আমার টাকাও শেষ ছেলেও শেষ। আমার কী হবে?
নিখোঁজ মাসুদ রানার বাড়িতে চলছে এমনই শোকের মাতম। জানা যায়, অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী মাসুদ বহু বছর আগেই হারিয়েছেন তার মা-বাবাকে। এতিম মাসুদের পরিবারের রয়েছে স্ত্রী আর এক সন্তান। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাসুদ। ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে তার মতোই সন্তানও হয়ে গেল এতিম।
বিজ্ঞাপন
স্বামী হারানোর শোকে প্রায় নিথর হয়ে যাওয়া মাসুদের স্ত্রী বলেন, দুইবারে আমার কাছ থেকে আট লাখ টাকার বেশি নিয়েছে। বলেছিল স্বামীকে পাঠিয়ে দেবে ইতালি। এখন তো আমি স্বামীও হারিয়েছি, টাকাও হারিয়েছি। ধার দেনা করে যে টাকা এনে দিয়েছিলাম এই টাকার ঋণ এখন শোধ করব কেমনে?’
গত বুধবার ভূমধ্যসাগরে ডিঙ্গি নৌকা ডুবে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে আট যুবক নিখোঁজ হন। এর মধ্যে সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। যাদের প্রত্যেকের বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়। পরিচয় পাওয়া যুবকরা হলেন বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের কাঙ্গালিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে মোখলেছুর রহমান (২০), একই এলাকার মৃত হাছেন আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন, কামাল হেসেন (৩৪), ভাটের চর গ্রামের হাসান উদ্দিনের ছেলে মাসুদ রানা (২২), দুলালকান্দি গ্রামের হারুন রশীদ রশিদের ছেলে মনির হোসেন (২২), একই এলাকার আব্দুল মোতালিব মিয়ার ছেলে রবিউল (৩৩), টান লক্ষ্মীপুর গ্রামের মহরম আলীর ছেলে স্বাধীন মিয়া (২০) ও নিলক্ষিয়া গ্রামের আমান মিয়া (২১)।
নিখোঁজ যুবকদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রত্যেকেই দালালের মাধ্যমে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি অনুসারে তাদের ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি নেওয়া হচ্ছিল।
নিখোঁজ যুবকদের স্বজনরা জানান, জেলার বেলাব উপজেলার দুলাল কান্দি গ্রামের লাল মিয়া ছেলে জাকিন হোসেন এবং নুর কাসেমের স্ত্রী শাহিনুর নামক দুই দালালের সাথে চুক্তি ছিল নিখোঁজ যুবকদের।
জানা যায়, যুবকদের নিখোঁজের সংবাদ স্বজনরা জানতে পারেন স্থানীয় স্থানীয় ইউপি সদস্য মিলনের মাধ্যমে।
ইউপি সদস্য মিলনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি খবর পেয়ে জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। ফোন দিলে মোবাইল অন্য একজন রিসিভ করে। যার কারণে জাকিরের সাথে আমার আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে যিনি আমার কল ধরেছিলেন তিনি জানিয়েছেন, জাকির হোসেন ওই দিন ২০ জনকে সাথে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিছুদূর যেতেই ডিঙ্গি নৌকা ডুবে যায়। এতে ১২ জনকে উদ্ধার করা গেলেও বাকি আটজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ কামাল মিয়ার ছোট ভাই জামাল মিয়া বলেন, প্রায় ৫-৬ মাস আগে আমার ভাইকে ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে ইতালি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে প্রথমে লিবিয়া নিয়ে যায়। এরপর বেশ কিছুদিন গেমঘরে রেখে গত বুধবার রাত ৮টায় ডিঙ্গি নৌকায় তুলে ইতালির পথে যাত্রা করে। যাত্রার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সাগরে ডিঙ্গিটি ডুবে যায়। এসময় ডিঙ্গিতে থাকা ২০ জন থেকে ১২ জন ফিরে এলেও আটজন নিখোঁজ হয়।
এদিকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী জানান, এভাবে যারা ইতালি যায়, তাদের সর্বপ্রথম লিবিয়া আনা হয়। এরপর একজন দালালের কাছে তাকে তুলে দেওয়া হয়। দালাল তার কাছ থেকে পাসপোর্টসহ সবকিছু নিয়ে নেয়। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গেইম ঘরে। সেখানে অন্ধকারে রাখা হয় তাদের অনাহার আর অর্ধাহারে। এসময় তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন ও চালায় দালাল পক্ষ। এভাবে আদায় করে নেওয়া হয় তার কাছ থেকে টাকা পয়সা। এরপর ছোট নৌকায় করে বেরিয়ে পড়ে ইতালির উদ্দেশে। যারাই এভাবে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের প্রত্যেক মুহূর্তে জীবনঝুঁকি থাকে।
এদিকে দুই দালালের বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। স্বজনদের কারও সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বেলাব থানার অফিসার ইনচার্জ মো. তানভীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। দালালদের কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা জান্নাত তাহেরা ঢাকা মেইলকে বলেন, নিখোঁজ যুবকদের সবাই অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছে। অবৈধপথে বিদেশ যাওয়া ঠেকানোর জন্য আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
প্রতিনিধি/জেবি