নোনাহার। নওগাঁর পোরশার প্রত্যন্ত গ্রাম। ঠাঠা বরেন্দ্রভূমি হিসেবেই পরিচিত এলাকাটি। তবে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই চিত্র বদলে গেছে। আম উৎপাদন করে ঈর্ষণীয় সাফল্যে পেয়েছেন এলাকার কৃষকরা। চাঙ্গা হয়েছে অর্থনীতি। এবার বরেন্দ্রভূমির এই সৌন্দর্য কাজে লাগিয়েছেন এক যুবক। গড়ে তুলেছেন কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ইতিমধ্যে এই ‘কুঁড়েঘর’ সাড়া ফেলেছে। বরেন্দ্রভূমির প্রাণ-প্রকৃতি আর বড় বড় আমের বাগান দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত প্রতিদিনই আসছেন দর্শনার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
এই কুঁড়েঘর রিসোর্ট তৈরির কারিগর বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ। ২০২১ সালে পোরশা উপজেলার নোনাহার গ্রামে এসে আম বাগান তৈরি করার জন্য স্থানীয়দের কাছ থেকে ৬০ বিঘা জমি লিজ নেন। পরে ওই জমিতে বিভিন্ন জাতের আম, পেয়ারা, ড্রাগন, আখ ও কফি চাষ শুরু করেন। সেখানে তিনি তার বাগান দেখাশোনার জন্য ছোট ছোট দুটো কুঁড়ে ঘর তৈরি করেন।
জানা গেছে, ঘরের দুটি ছবি ও ভিডিও তিনি তার ফেইসবুক এবং নিজস্ব ওয়েবসাইটে পোষ্ট করেন। প্রথম দিকে তার বিভিন্ন এলাকার বন্ধু ও আত্মীয়রা এখানে ঘুরতে আসেন। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলে তিনি পরবর্তীতে আরও কিছু ঘর তৈরি করেন।
এই খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামীণ পরিবেশ, নির্মল বাতাস, নানা বৈচিত্র আর সবুজের সমাহার উপভোগ করার জন্য দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন সেখানে। রাত যাপনের ইচ্ছে পোষণ করতেন। আর সুযোগটায় কাজে লাগান মুজাহিদুল ইসলাম। পরিকল্পনা করে গড়ে তুললেন পর্যটন কেন্দ্র।
বিজ্ঞাপন
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এটিকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন মুজাহিদুল ইসলাম। নাম দেন ‘কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট’। দর্শনার্থী ও ভ্রমণপ্রেমিদের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে এই রিসোর্টে তৈরি করা হয়েছে ৭টি ঘর। এরমধ্যে রয়েছে ২টি ফ্যামিলি রুম, ৪টি সিঙ্গেল রুম ও ১টি কমন রুম। ৭টি রুমে ২০ জন দর্শনার্থী থাকতে পারবেন। প্রতিরাতের জন্য ফ্যামিলি ও কমন রুমের ভাড়া ৬০০ টাকা। সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ১ জন ২০০ ও ২ জন ৩০০ টাকা। এখানে রয়েছে অ্যাটাচ ও কমন বাথরুম, রয়েছে বিদ্যুৎ এবং পানির সু-ব্যবস্থা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নোনাহার পশ্চিমপাড়া গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তা শেষ হয়ে প্রায় ২০০ ফিট মেঠো পথ পেরুলেই কুঁড়ে ঘর ম্যাঙ্গো রিসোর্টের গেইট। বড় ও ছোট ছোট আম বাগানের মধ্যে পাশেই তৈরি করা হয়েছে রিসোর্টটি। মাটির তৈরি সারি-সারি ঘর, আঙ্গিনায় সারি-সারি ফুল গাছ। তাল পাতা দিয়ে ঘেরা আঙ্গিনা। আঙ্গিনায় দড়ির তৈরি খাট। চারিদিকে সবুজে ঘেরা। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। স্থানীয় বাঁশের কঞ্চি ও মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঘর। প্রথমে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেড়া। ঘরের দেওয়ালগুলো বাঁশের কঞ্চির বেড়ার উপর মাটির প্রলেপ তৈরি করা হয়েছে। পাশের বিলের বিন্না ঘাস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঘরের চাল। ঘরের ভেতর থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে খাট, মেঝেতে রয়েছে কার্পেট।
সেখানে কথা হয় রাজশাহী থেকে কুঁড়েঘরে ঘুরতে আসা নাভানা মুসতারিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিসোর্টের ছবি দেখেছি। এরপর প্ল্যান করে আম বাগান এই প্রকৃতির আর কুঁড়েঘর দেখতে চলে আসা। এমন গ্রামীন পরিবেশে সময় কাটাতে পেরে তারা অনেক আনন্দিত।
পাশ্ববর্তী বগুড়া জেলা শহর থেকে এসেছেন সিফাত খন্দকার ও সোহান হোসেন। এখানে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে তারা বলেন, চমৎকার পরিবেশ। আমের নতুন রাজধানী খ্যাত নওগাঁ জেলার। তার মাঝে কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট। দারুণ এক অনুভূতি হচ্ছে। সবুজে ঘেরা গ্রামীন পরিবেশে এক রাত থাকতে পেরে বেশ ভালো লেখেছে। গ্রাম প্রধান আমাদের এই দেশ, আর গ্রামীণ এই পরিবেশে মন ছুঁয়ে গেছে।
রিসোর্টটির ম্যানেজার মাসুদ রানা বলেন, সেখানে ধুমপান নিষেধ। বিবাহিত ছেলে-মেয়ে এক সাথে থাকতে চাইলে তাদের বিয়ের কাবিননামা ও ভোটার আইডি কার্ড জমা নেওয়া হয়। রিসোর্টে থাকাকালিন যারা এখানে খেতে চান তারা খরচ দিয়ে খেতে পারবেন। বেশিরভাগ সময়ই রুম বুকড থাকে, তাই এখানে আসার দুইদিন আগেই জানিয়ে আসতে হবে। এজন্য ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজ অথবা সরাসরি মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারবেন।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম দিকে তিনি এখানে এসে আমবাগান তৈরি করেন এবং পরবর্তীতে তিনি গরুও পালন করতে থাকেন। এলাকাটি তার কাছে কিছুটা পার্বত্য রাঙামাটি এলাকার মতো মনে হয়। তার এই প্রজেক্টগুলোর ছবি এবং পোরশা এলাকার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং এলাকার উঁচু-নিচু বরেন্দ্রভূমির বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও তার ফেইসবুক ও ওয়েবসাইটে পোস্ট করলে বিভিন্ন মানুষ এখানে আসতে চাইতেন।
মানুষের চাহিদা মেটাতে তার এই রিসোর্ট তৈরি করা। বেশ সাড়া পাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে এসে রাতযাপন করছেন। আগামীতে তিনি এখানে কমিউনিটি ট্যুরিজমের ব্যবস্থা ও বোর্ড হাউজ করাসহ পোরশাকে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন বলেও জানান তিনি।
পোরশা উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইএনও) সালমা আক্তার বলেন, কুঁড়েঘর ম্যাংগো রিসোর্ট চমৎকার একটি আইডিয়া। এ অঞ্চলের পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু। দেশের অনেক স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসছেন, রাতযাপন করছেন। সেজন্য আমরা মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদকে জেলা প্রশাসন থেকে আবাসিক লাইসেন্স করতে বলেছি। এছাড়া আমাদের কোনো সহায়তা প্রয়োজন হলে অবশ্যই তা করা হবে।
প্রতিনিধি/এইউ