images

তথ্য-প্রযুক্তি

ভূমিকম্পের ফেক ছবি-ভিডিও দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা!

আসাদুজ্জামান লিমন

২২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পে গতকাল শুক্রবার কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকা। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫.৭।  ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই ভূমিকম্পে ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। 

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের খবর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই সুযোগে কিছু মানুষ ভূমিকম্পের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এইআই) দিয়ে তৈরি ফেক ছবি ও ভিডিও তৈরি করে প্রচার করতে থাকে। যা নেটনাগরিকদের মাঝে ভীতি সঞ্চার করে। দুর্ঘটনার কাল্পনিক বা মিথ্যা তথ্য, ছবি ও ভিডিও দেখে তারা আবেগ সংবরণ করতে পারেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ফেক তথ্য ছড়ানোর পর তারা সহানুভূতি প্রকাশ করেন। অথচ এইআই নির্ভর এসব ছবি ও ভিডিও ছিল ফেক বা মিথ্যা। 

আরও পড়ুন: দুর্যোগের সময় নিজেকে ফেসবুকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করার উপায়

বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসেরও নজরে আসে। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার খালেদা ইয়াসমিন গণমাধ্যমকে শুক্রবার বলেন, রাজধানীর অনেক জায়গায় কিছু ভবনে ফাটল ধরেছে এবং হেলে পড়েছে, আবার কিছু ভবনের অংশবিশেষ ভেঙে পড়েছে। তবে আমাদের কাছে একের পর এক ভবন ধসে পড়ার খবর আসছে, যা গুজব।

তিনি বলেন, ‘অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গুজব হচ্ছে যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে আমাদের টিম সেখানে গিয়ে দেখে কোনো কিছুই হয়নি।’

share

ভূমিকম্পের পর বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে দেদারসে প্রচার হতে থাকে। ব্যবহারকারীরা এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে শেয়ার করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো ঢাকার একটি ভবন হেলে আরেকটি ভবনের সঙ্গে ধসের ভিডিও। এতে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্থ ভবন থেকে এয়ারকন্ডিশন (এসি), ভবনের দেয়ালের কিছু অংশ, ইট খসে খসে নিচে পড়ছে। যা আদতে সত্যি হয়। ভিডিওটি এআই দিয়ে নির্মিত ছিল। 

শেয়ার করা আরেকটি ভিডিওর দেখা যায়, ভূমিকম্পে একটি উড়াল সড়কের গার্ডার ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ভিডিওর বর্ণনাতে উল্লেখ করা হয়, ভূমিকম্পে আশুলিয়ার একটি ফ্লাইওভারের সাইড ওয়াল ধসে অনেক মানুষ আহত হয়েছেন।

ঢাকা মেইলের ফ্যাক্ট চেকিং টিম খতিয়ে দেখেছে গতকাল এমন কোনো দুর্ঘটনাই ঘটেনি। ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নির্মিত। 

ভূমিকম্প_পিক

এমন বেশ কিছু ফেক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা এই ঘটনার সত্যতা যাচাই না করে সত্যি বলে ধরে নেন। এমনকি ভিডিওর দর্শকরা সহানূভূতিও প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ কতটা অসহায় সেসব কথাও।

ফেক বা এআই নির্মিত ছবি-ভিডিও চিনবেন যেভাবে

শুক্রবার ঢাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় আরেক ধরনের ‘কম্পন’ ফেক ছবি ও ভিডিওর বন্যা। শহরের বিভিন্ন স্থাপনা ধসে পড়েছে, রাস্তায় ফাটল ধরেছে কিংবা মানুষ আহত হয়েছে—এমন দাবি জুড়ে দিয়ে পুরোনো কিংবা বানানো ভিডিও ভাইরাল হতে থাকে মুহূর্তেই। এতে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে, আর মানুষের মধ্যে বাড়ে অযথা আতঙ্ক।

এই ডিজিটাল যুগে গুজবের গতি ভূমিকম্পের কম্পনকে ছাড়িয়ে যায়। তাই ভুয়া ছবি ও ভিডিও শনাক্ত করার কৌশল জানা এখন জরুরি। নিচে সহজ কিছু উপায় তুলে ধরা হলো—

১. ছবির উৎস (Source) যাচাই করুন

ভাইরাল হওয়া কোনো ছবি দেখলেই প্রথম কাজ হলো এটি কোথা থেকে এসেছে তা বোঝা।

অজানা পেজ, ফেক আইডি বা গুজব–সৃষ্টিকারী গ্রুপে শেয়ার হলে তা সন্দেহজনক।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম বা সরকারি সংস্থার অফিসিয়াল পেজে যদি তথ্যটি না থাকে, তাহলে সেটি নিশ্চিত হওয়ার আগেই শেয়ার করা উচিত নয়।

আরও পড়ুন: হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলে কী করবেন, কী করবেন না

২. রিভার্স ইমেজ সার্চ ব্যবহার করুন

ফেক ছবির বড় অংশই পুরোনো ঘটনা বা অন্য দেশের ছবি।

গুগল, TinEye বা Yandex–এ গিয়ে ছবি আপলোড করলে দেখা যাবে—

ছবিটি আগে কোথায় ব্যবহার হয়েছে

কোন তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল

এটি অন্য ঘটনার ছবি কি না

অনেক সময় ৫–১০ বছর আগের বিদেশি দুর্ঘটনার ছবিও নতুন বলে চালানো হয়।

েএক্সিডেন্ট

৩. ভিডিওর মেটাডাটা ও অডিও শুনুন

ভিডিওতে অস্বাভাবিকতা খুঁজুন—

মানুষের ভাষা বা উচ্চারণ কি স্থানীয়?

ভিডিওর পরিবেশ কি ঢাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

ছায়া, আলো বা আবহাওয়া কি ঘটনার সময়ের সঙ্গে মেলে?

ভিডিওর অ্যাসপেক্ট রেশিও বা কোয়ালিটি সন্দেহজনক কি না?

অনেক সময় ভূমিকম্পের ভিডিও বলে যে ভিডিও ছড়ানো হয়, তাতে ভাষা, যানবাহন বা আশপাশের স্থাপনা দেশের সঙ্গে মেলে না।

৪. ভিডিও স্টপ করে ফ্রেম বিশ্লেষণ করুন

ভিডিও থামিয়ে থামিয়ে দেখুন—

ছবির প্রান্তে কার্টুন–মতো কাটিং, বিল্ডিংয়ের অদ্ভুত দুলুনি বা হঠাৎ পিক্সেল ভাঙা—এসবই এডিটিংয়ের লক্ষণ।

আরও পড়ুন: ভূমিকম্পের পর আফটার শক কেন হয়?

কিছু অংশ অস্বাভাবিক দ্রুত বা ধীরভাবে নড়ছে কি না দেখুন।

এ ধরনের অনিয়ম সাধারণত কৃত্রিমভাবে বানানো ভিডিওতে থাকে।

৫. সংবাদমাধ্যম ও সরকারি সংস্থার তথ্য মিলিয়ে নিন

ভূমিকম্পের মতো বড় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রথমে নিশ্চিত করে—

ফায়ার সার্ভিস

পুলিশ

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র

বিশ্বস্ত মূলধারার সংবাদমাধ্যম

যদি কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর না থাকে, অথচ ভিডিওতে ব্যাপক ধ্বংসের দৃশ্য দেখানো হয়—তাহলে সেটি নিশ্চিতভাবেই ভুয়া।

588350070_1370521587990527_1171990879151268222_n

৬. সন্দেহজনক পোস্টে অতিরিক্ত আবেগ বা নাটকীয় ভাষা দেখুন

যেসব পোস্টে লেখা থাকে—

“ভাই, সবাই সাবধান!”

“এখনই দেখুন!”

“লাইক–শেয়ার করুন, সবাই জানুক!”

এসব সাধারণত ক্লিকবেইট বা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়।

৭. স্থান–কাল যাচাই (Geo–verification) করুন

ছবিতে থাকা—

রাস্তাঘাট

ভবন

দোকানের সাইনবোর্ড

গাড়ির নম্বরপ্লেট

এসব ঢাকার সঙ্গে মিলছে কি না দেখতে পারেন। অনেক সময় পাকিস্তান, নেপাল বা জাপানের ভূমিকম্পের ছবি ঢাকার নামে ছড়ানো হয়।

৮. এআই–জেনারেটেড (AI-generated) ছবির লক্ষণ চিনুন

এআই–তৈরি ছবিতে সাধারণত...

হাতের আঙুল বিকৃত

মানুষের মুখে অস্বাভাবিকতা

ছায়া ও আলোর অসামঞ্জস্য

ব্যাকগ্রাউন্ডে ভাঙা লেখা বা অস্পষ্ট সাইনবোর্ড

এসব চোখে পড়ে। এগুলোই ফেক হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

কেন ভুয়া ছবি–ভিডিও এত দ্রুত ছড়ায়?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন

মানুষ ভয় পেলে যাচাই না করেই তথ্য শেয়ার করে

ক্লিকবেইট পেজগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পুরোনো ছবি ব্যবহার করে

অনেকেই ভাইরাল হতে বা লাইক–শেয়ারের জন্য ভুয়া কনটেন্ট বানায়

ফলে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে অসত্য তথ্য গুলিয়ে যায়, যা সমাজে আতঙ্ক তৈরি করে।

আরও পড়ুন: ভূমিকম্প কেন হয়

ভুয়া ছবি–ভিডিও বন্ধে কী করা উচিত

নিশ্চিত না হয়ে কোনো ছবি–ভিডিও শেয়ার করবেন না

বন্ধুবান্ধবকে সতর্ক করুন

ফেক পোস্ট রিপোর্ট করুন

বিশ্বস্ত উৎসের তথ্য অনুসরণ করুন

এজেড