ধর্ম ডেস্ক
২৩ মে ২০২৩, ০৪:৫৮ পিএম
হজ ইসলামের পাঁচ ভিত্তির একটি। হজ অর্থ সংকল্প করা। পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজের মাসের নির্ধারিত দিনগুলোতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ ও সংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাই হজ। (কাওয়াইদুল ফিকহ)
বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, উম্মতে মুহাম্মদির ওপর নবম হিজরিতে হজ ফরজ করা হয়েছে। শরিয়তের বিধান মোতাবেক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরের হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)
এই আয়াতটি আমুল ওফুদ (প্রতিনিধিদল আগমনের বছর) তথা নবম হিজরির শেষদিকে নাজিল হয়েছে। অতএব, নবম হিজরিতেই আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদির ওপর হজ ফরজ করেছেন। (দ্রষ্টব্য: জাদুল মাআদ: ৩/৫৯৫)
তবে, হজের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হয়েছিলেন। সেই স্মৃতি ধারণ করে ৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে ১০ জিলহজ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় কিছুক্ষণের জন্য হলেও আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের রুকন।
আরও পড়ুন: আরাফার দিন রোজা রাখার ফজিলত
পরে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা এবং তাঁদের সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর মাধ্যমে প্রচলন হয় সাফা-মারওয়া সাঈ, মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এবং কোরবানি আদায় করার আমল।
ইসমাইল (আ.)-এর মৃত্যুর পর পবিত্র কাবা বিভিন্ন জাতি-উপজাতির দখলে চলে যায় এবং তারা একে মূর্তিপূজার জন্য ব্যবহার করতে থাকে এবং এসময় উপত্যকা এলাকায় মৌসুমী বন্যার কবলে পড়ে কাবা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। অতঃপর ৬৩০ সালে মুহাম্মদ (স.) কাবাকে আবাদ করে পুনরায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন।
এভাবে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সর্বযুগের আল্লাহপ্রেমিক, আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ নবী-রাসুলগণসহ আল্লাহর নেককার, সত্যপ্রাণ ও মাকবুল বান্দাগণের পরম ব্যকুলতার সঙ্গে আল্লাহর ঘরে হাজিরা দেওয়ার মাধ্যমে রচিত হয়েছে হজ ও জিয়ারতের প্রেমময় বিধান। (সূত্র: মারেফুল কোরআন)
আরও পড়ুন: পবিত্র কাবাঘরের ইতিহাস
কুরাইশরা যখন কাবা পুণঃনির্মাণ করেন, তখন জান্নাত থেকে আসা পাথর ‘হাজারে আসওয়াদকে কাবার এক কোণে স্থাপন করা হয় মুহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে। কাবার এক পাশে একটি স্থান রয়েছে যার নাম ‘মাকামে ইবরাহিম’; এখানে দাঁড়িয়ে ইবরাহিম (আ.) কাবার নির্মাণকাজ করতেন এবং পর্যবেক্ষণ করতেন, এখানে একটি পাথরে তাঁর পদছাপ রয়েছে। কাবাঘরের উত্তর দিকে কাবা সংলগ্ন অর্ধ-বৃত্তাকার একটি উঁচু দেয়াল আছে যা কাবা ঘরেরই অংশ যার নাম ‘হাতিম’ বা হিজর। হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মাঝের স্থানকে ‘মুলতাজাম’ বলা হয়। কাবাঘরকে বৃষ্টি ও ধুলাবালী থেকে রক্ষার জন্য একটি চাদর দিয়ে আবৃত করে রাখা হয় যা ‘গিলাফ’ নামে পরিচিত।
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) বায়তুল্লাহ শরিফে হজ আদায় করেন। পর্যায়ক্রমে হজরত নূহ (আ.)-সহ অন্যান্য নবী ও রাসুলগণ বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন। (আখবারে মক্কা)
হজরত নূহ (আ.)-এর যুগের মহাপ্লাবনে কাবা শরিফ ধসে যায়। পরে আল্লাহর হুকুমে হজরত ইবরাহিম (আ.) সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘরের পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ইতেকাফকারীদের, রুকু ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে।’ (সুরা বাকারা: ১২৫)
নির্মাণ শেষ করার পর ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর দরবারে আকুল প্রার্থনা করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আজ্ঞাবহ করো, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো, আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা করো। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এ কাজটি কবুল করো।’
আরও পড়ুন: মায়ের দিকে শুধু তাকালেই কবুল হজের সওয়াব
আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করে নির্দেশ দিলেন, ‘(হে ইবরাহিম!) তুমি মানবজাতিকে হজের জন্য আহবান করো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে তোমার কাছে আসবে হেঁটে। আসবে সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে সওয়ার হয়ে।’ (সুরা হজ: ২৭)
এ আয়াতের তাফসিরে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইবরাহিম (আ.) পবিত্র কাবা শরিফ নির্মাণের পর আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার নির্দেশে বায়তুল্লাহকে নির্মাণ করেছি। অতঃপর আল্লাহ তাকে হজের ঘোষণা দিতে আদেশ দিলেন- তিনি বললেন, আমার আওয়াজ কী করে (অতদূর) পৌছবে? আল্লাহ তাআলা বললেন, তুমি ঘোষণা করে দাও। তোমার ঘোষণার আওয়াজ বিশ্ব মানবতার কানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন হে রব! ঘোষণায় কী বলব? আল্লাহ বললেন, বলো- ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিতে এবং জান্নাতে পৌঁছাতে আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’
হজরত ইবরাহিম (আ.) ঘোষণা দিলে আসমান ও জমিনের সবাই সে ঘোষণা শুনতে পায়। (তাফসিরে কুরতুবি: ১২/৩৭)
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হজরত ইবরাহিম (আ.) আবু কুবাইস পাহাড়ে উঠে নিজের দুকানে আঙ্গুল দিয়ে সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, হে মানব সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। তোমরা তোমাদের প্রভুর আহবানে সাড়া দাও। তখন পুরুষের ঔরসে ও নারীর গর্ভে যারা ছিল সবাই ‘লাব্বাইকা’ বলে সাড়া দিল। (তাফসিরে রুহুল মাআনি: ১৩/৪৮)
হজরত সাইদ ইবনে জুবাইর (রা.) বলেন, হজের জন্য বিশ্বমানবতাকে আহবান করার পর পাহাড় ঝুঁকে পড়ে। সমস্ত দুনিয়ায় এ ঘোষণার আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়। পিতার ঔরসে, মায়ের গর্ভে যারা ছিল তাদের কানেও আল্লাহ তাআলা সে শব্দ পৌঁছে দেন। পাথর, বৃক্ষরাজি এবং প্রত্যেক ওই ব্যক্তি যার হজ নসিব হবে সবাই সমস্বরে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে ওঠে। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/৪১৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে বুকে ধারণ করে হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পালন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
হজ কোন হিজরিতে ফরজ, হজ ফরজ হওয়ার সময়কাল, হজের ইতিহাস, হজ্জের ইতিহাস ও তাৎপর্য, হজ্জের আলোচনা, হজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, হজের কার্যক্রম, হজের কাহিনী, প্রতি বছর হজ