ধর্ম ডেস্ক
১০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৫১ পিএম
আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ এর ফারসি ‘শবে কদর’। লাইলাতুন বা শব-এর অর্থ রাত। কদর-এর অনেক অর্থ, যেমন- পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ, ভাগ্য নিরূপণ, সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ভাগ্যনির্ধারণী রজনী।
এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন)
পবিত্র কোরআন নাজিল হয় লাইলাতুল কদরে। এ কারণেই রাতটির এত বড় মর্যাদা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি একে অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে।’ (সুরা দুখান: ৩)
পূণ্যময় এ রাতের সম্মানে পবিত্র কোরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা ‘সুরাতুল কদর’নাজিল হয়েছে। এ সুরায় বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (সুরা কদর: ১-৫)
হাজার মাসের চেয়ে উত্তম অর্থ শুধু যে একহাজার মাসের চেয়ে উত্তম-বিষয়টি এমন নয়, বরং অনেক বেশি বোঝাতেও হাজার শব্দটা ব্যবহার করা হয়। তারপরও আমরা যদি এখানে শুধু এক হাজার মাসই ধরি এর সময় দাঁড়ায় ৮৩ বছর ৪ মাস। তার মানে ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এ এক রাতের ইবাদতের দ্বারাই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন।
আরও পড়ুন
শবে কদরের দোয়া
শবে কদর কি ২৭ রমজানেই?
‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে (ঈমানসহ) এবং সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এ রাতে জেগে ইবাদত বন্দেগি করবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সব পাপ মোচন করে দেওয়া হবে।’ রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, ‘এ মাসে (রমজানে) এমন একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত হলো।’ (সুনানে নাসায়ি: ২১০৮)
কিন্তু শবে কদর কবে? রমজানের কোন রাতটিকে শবে কদর বলা হয়? এর সরাসরি কোনো উত্তর কোরআন-হাদিসে আসেনি। তাই নবীজি রমজানের শেষ দশকে শবে কদর তালাশ করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ করো।’(বুখারি: ২০১৭)
উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (স.) ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন। এ সময় দুইজন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী কারিম (স.) বললেন, ‘আমি আপনাদের ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, উঠিয়ে নেওয়াটা আপনাদের জন্য বেশি ভালো হয়েছে। আপনারা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৪৯)
মূলত শবে কদরের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অজানা রাখার পেছনে আল্লাহ তাআলার বিশেষ হেকমত নিহিত। এতে উম্মতের কল্যাণ রয়েছে বলেই নবীজিকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাফসিরের কিতাবগুলোতেও এটাই সার সংক্ষেপ। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘আলেমগণ বলেন, এই রাতটির নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখার পিছনে হেকমত হলো—
মানুষ যেন এ রাতের মর্যাদা লাভের জন্য চেষ্টা সাধনা করে। নির্দিষ্ট তারিখ জানা থাকলে— মানুষ শুধু নির্দিষ্টভাবে সেই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করত। (ফাতহুল বারি: ৪/২৬৬)
তবে, শবে কদরের সম্ভাব্য হিসাবে রমজানের ২৭তম রাতকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। হাদিসের গবেষকরা বলেন, রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (ফাতাওয়াউল লাজনাহ আদ্-দায়িমা; সৌদি আরবের ফতোয়াবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/৪১৩)
আরও পড়ুন
ইতেকাফ কী? গুরুত্ব ও ফজিলত
রমজানে নারীরা যেসব আমলে মনোযোগী হবেন
তবুও একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। বরং শেষ দশকের সবরাতেই যথাসম্ভব শবে কদরের তালাশ করা উচিত। বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলো। এটিই নবী (স.)-এর আদর্শ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—‘রমজানের শেষ ১০ রাত শুরু হলে— নবী (স.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারের সবাইকে (ইবাদতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি: ২০২৪; সহিহ মুসলিম: ১১৭৪)
মহিমান্বিত এ রজনীর সব নেয়ামত হাসিলের জন্য প্রথমেই শিরকমুক্ত ঈমান, পরিশুদ্ধ নিয়ত ও বেদআতমুক্ত আমলের মাধ্যমে রাতযাপন করতে হবে। কদর লাভের আশায় শেষ ১০ দিনে ইতেকাফ করা, বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ও তওবা-ইসতেগফার করা উচিত।
এ রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে মনগড়া কিছু আমলের প্রচলন দেখা যায়, যা শরিয়তসম্মত নয়। যেমন লাইলাতুল কদরের নামাজ বলে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ পড়া, দলবদ্ধভাবে একেক মসজিদে ঘুরে ইবাদত করা, আতশবাজি ফোটানো ইত্যাদি। এ রাত যাপন উপলক্ষে অহেতুক কোনো অনুষ্ঠান বা মসজিদে কোনো ভোজের আয়োজন করা ইসলামসম্মত নয়।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল কিন্তু ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটাতে পারল না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। সুতরাং লাইলাতুল কদর তালাশ করে সঠিক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রাত যাপনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
কেউ শবে কদর পেলে, তার জন্য একটি বিশেষ দোয়ার উল্লেখ রয়েছে হাদিসে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর— তাহলে তখন কোন দোয়া পড়বো? তখন তিনি বললেন, তুমি বলো— اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ كريمٌ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি। অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিজি: ৩৫১৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে শবে কদর নসিব করুন। আমিন।