পবিত্র রমজানে আল্লাহর নৈকট্যলাভের একটি বড় মাধ্যম ইতেকাফ। লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তি, গুনাহ থেকে পরিত্রাণ, বাকি ১১ মাসের ইবাদতের যথার্থ অনুশীলনসহ অসংখ্য বরকতসমৃদ্ধ আমল করা হয় রমজানের শেষ দশকের এই ইবাদতের মাধ্যমে।
ইতেকাফের পরিচয়
বিজ্ঞাপন
ইতেকাফ শব্দের অর্থ স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায়, মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন বা যেকোনো দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম তথা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা ঘরের পবিত্র স্থানে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মসজিদে ইতেকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবে না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)
ইতেকাফের উদ্দেশ্য
দুনিয়াদারির ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া এবং বিনয় ও নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করা, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও এই মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম ১০ দিন ও মাঝের ১০ দিন ইতেকাফ করেছি, অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেছেন, তা শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতেকাফ করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে।’ অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গে শেষ দশকে ইতেকাফ করলেন। (মুসলিম)
ইতেকাফের শর্তসমূহ
বিজ্ঞাপন
ইতেকাফের শর্তগুলো হলো-
১. নিয়ত করা ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফ হতে হবে ৩. ইতেকাফকারী রোজাদার হবে ৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-নেফাস হতে পাক হওয়া ৬. পুরুষ লোক জামে মসজিদে ইতেকাফ করবে ৭. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকতে হবে।
ইতেকাফের প্রকারসমূহ
ইতেকাফ তিন প্রকার—
১) সুন্নত ইতেকাফ: রমজানুল মোবারকের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফই সুন্নত। ২১ তারিখের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। কারণ রাসুলুল্লাহ (স.) প্রতি বছর এ দিনগুলোতে ইতেকাফ করতেন। একারণে একে সুন্নত ইতেকাফ বলা হয়। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে যে—
‘রাসুলুল্লাহ (স.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। এরপর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ ইতেকাফ করতেন’। (বুখারি: ১/২৭১)
উল্লেখ্য: সুন্নত ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে, তা কাজা করা ওয়াজিব।
২) ওয়াজিব ইতেকাফ: মানতের ইতেকাফ ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মানত পূর্ণ করে।’ (সুরা হজ: ২৯)
তাতে কোনো শর্ত থাকুক বা না থাকুক। যেমন- কেউ বললো, ‘আমার এই কাজ সমাধা হলে আমি ইতেকাফ করবো’, এতে যেমন ইতেকাফ ওয়াজিব হবে, ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে-
‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইতেকাফ করবো’, এ অবস্থাতেও ইতেকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে।‘ (ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২১৩, দুররুল মুখতার: ২/৪৪১)
৩) নফল ইতেকাফ: এই ইতেকাফ যেকোনো সময় করা যায়। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ। রোজার প্রয়োজন নেই। এমনকি মসজিদে প্রবেশ করার সময় নফল ইতেকাফের নিয়ত করা সুন্নত। এই তিন ধরনের ইতেকাফের ভিন্ন ভিন্ন বিধান আছে।
ইতেকাফের স্থান
পুরুষরা শুধু মসজিদেই ইতেকাফ করতে পারে। ইতেকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদে হারাম, তারপর মসজিদে নববি, তারপর মসজিদে আকসা, এরপর যেকোনো জামে মসজিদ।
জামে মসজিদে ইতেকাফ উত্তম। কারণ জুমার জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। কিন্তু জামে মসজিদে ইতেকাফ করা জরুরি নয়। বরং যেসব শরয়ি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, সে মসজিদে ইতেকাফ করতে পারে। (ফতোয়া শামি: ২/১২৯)
নারীর ইতেকাফ
নারীদের জন্য ইতেকাফ করা মুস্তাহাব। নারীদের ইতেকাফ গৃহকোণে (নামাজের স্থানে) বাঞ্ছনীয়। নারীদের ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি আবশ্যক।
স্বামী স্ত্রীকে ইতেকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুখতার: ২/৪৪১; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১১)
ইতেকাফ অবস্থায় রাতেও স্ত্রী-সহবাস করা যাবে না। করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তদ্রূপ স্ত্রীকে চুম্বন, আলিঙ্গন ও উত্তেজনার সাথে স্পর্শ করাও বৈধ নয়। যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে, তাহলে ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। (সুরা বাকারা: ১৮৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৫, আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৫০; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১৩)
মহিলাদের ঋতুস্রাব অবস্থায় ইতেকাফ করা সহিহ নয়। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪; ফতোয়া আলমগিরি: ১/২১১)
ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইতেকাফ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থেই বাহ্যত আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন- ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি: ২০২০)
রমজানের সুন্নত ইতেকাফকারীদের ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগে মসজিদের সীমানায় প্রবেশ করতে হবে এবং ২৯ বা ৩০ রমজান পরবর্তী মাস তথা শাওয়ালের চাঁদ দেখে মসজিদ থেকে বের হতে হবে। রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যে কোনো একজন ইতেকাফ করলে পুরো মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হয়ে যাবে।
কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতেকাফ না করে তবে মহল্লার সবার সুন্নত পরিত্যাগের গোনাহ হবে। (দুররুল মুখতার: ২/৪৪০)
ইতেকাফ অবস্থায় কেউ যদি রাতে ঘুমিয়েও থাকে, তবু তাকে ইবাদতকারীদের মধ্যে শামিল করা হবে। তখন শবেকদরের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে ব্যয় করার ফজিলত অর্জন করবেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘ইতেকাফকারী গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। তার সব নেক আমল এমনভাবে লিপিবদ্ধ হতে থাকে, যেভাবে সে নিজে করত।’ (ইবনে মাজাহ)
ইতেকাফের ফজিলত বর্ণনায় হাদিসে প্রিয়নবী (স.) ঘোষণা দেন-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব দুই দিগন্তের দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্ব হবে।’ (কানযুল উম্মাল: ২৪০১৯)
ইতেকাফকারী দুই হজ ও দুই ওমরার সাওয়াব পাবেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করবে তার আমল দুই হজ ও দুই ওমরার সমতুল্য’ (শুআবুল ইমান: ৩৬৮১; কানযুল উম্মাল: ২৪০০৬)
ইতেকাফকারী লাইলাতুল কদরের মর্যাদা লাভ করতে পারবেন। কেননা রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোর যেকোনো একটিতে লাইলাতুল কদর রয়েছে। আর লাইলাতুল কদরের ইবাদত হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। সুতরাং যে ব্যক্তি শেষ দশকে ইতেকাফ করবে তার প্রতিটি মুহূর্ত যেহেতু ইবাদত হিসেবে গণ্য হচ্ছে ফলে সে লাইলাতুল কদর পেয়ে যাচ্ছেন, এ রাতের সুমহান মর্যাদা লাভ করতে পারছেন। রাসুল (সা.) লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির আশা নিয়েই ইতেকাফ করতেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইতেকাফের গুরুত্ব বোঝার এবং সেই অনুযায়ী আমল ও লাইলাতুল কদর পাওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।