images

ইসলাম

কাবা বায়তুল্লাহ: আল্লাহর কুদরতি নিদর্শন

হারুন জামিল

২১ মার্চ ২০২৩, ০৩:৪৪ পিএম

images

পবিত্র কাবা বায়তুল্লাহ আল্লাহ তায়ালার এক কুদরতি নিদর্শন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই তিনি কাবাকে তাঁর মকবুল বান্দাদের বন্দেগির কেন্দ্র হিসেবে মনোনীত করেছেন। কাবা আল্লাহর ঘর। এই ঘরকে কেন্দ্র করেই বিশ্বাসীরা কালে কালে একত্রিত হয়েছেন। এখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিটি বিশ্বাসী মানুষ তাঁর স্রষ্টার কাছে আকুলতা প্রদর্শন করে। এ ঘর নিজে উপাস্য নয়। এ গৃহের মালিকের ইবাদত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র আল কোরআনের সুরা কুরাইশে বলা হয়েছে- ‘তোমরা এ গৃহের মালিকের বন্দেগি করো।’

সৃষ্টির শুরু থেকে কাবাঘরকে কেন্দ্র করে মানুষ ইবাদাতে মশগুল ছিল। পবিত্র কোরআনে এ ঘর তাওয়াফ করার জন্য বলা হয়েছে। এ গৃহ আদিকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র। কাবা বায়তুল্লাহকে নিয়ে এমন বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, যা এর মালিকের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হয়ে আছে।

কাবা শরিফ নির্মাণ সংস্কারের ইতিহাস: কাবা শরিফের ঠিক ওপরে উর্ধাকাশে 'বায়তুল মামুরে' ফেরেশতারা আগে থেকেই তাওয়াফ করে আসছিলেন। সেখানে কাবার অনুরূপ ঘর রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা জমিনের ফেরেশতাদের বলেন, 'তোমরা বাইতুল মামুরের আদলে একটি ঘর নির্মাণ করো।' তখন তাঁরা কাবা শরিফ নির্মাণ করেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁদের কাবাগৃহ তওয়াফ করার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুন: তায়েফ: যেখানে এখনো অশ্রু ঝরে

বর্ণিত আছে, হজরত আদমই আ. কাবাগৃহের প্রথম নির্মাতা। বেহেশতে এ গৃহের আদলে ঘর দেখে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। পাঁচটি পাহাড়ের পাথর দিয়ে কাবাগৃহ নির্মাণ করা হয়। জাবালে হেরা, জুদি, লুবনান, সিনাই ও জাইতুন। ফেরেশতারা এ পাথরগুলো এনে দিতেন।

ইবরাহিম ইসমাইল .-এর নির্মাণ: হজরত নূহ আ.-এর যুগে মহাপ্লাবনে কাবাগৃহ ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর  মহান আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আ. কাবাগৃহ পুনঃর্নিমাণ করেন। ইসমাইল আ. পাথর নিয়ে আসতেন এবং ইবরাহিম আ. নির্মাণকাজ করতেন। একপর্যায়ে কাবার দেয়াল উঁচু হয়ে গেলে তখন আল্লাহর কুদরতে একটি পাথরও উঁচু হয়ে যেত এবং সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। ইবরাহিমের আ.পায়ের চিহ্নযুক্ত পাথরখানা আজও কাবা চত্বরে স্থাপিত আছে। তখনও কাবার কোনো ছাদ নির্মাণ করা হয়নি। উচ্চতা ছিল ৯ হাত, দৈর্ঘ্য ৩০ হাত ও প্রস্থ ২২ হাত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সে নির্মাণের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় চার হাজার বছর।

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়,পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি কাবাকে কেন্দ্র করেই।  মক্কা ও কাবার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইবরাহিম আ.এর -স্মৃতি। আহলে কিতাবের অনুসারীদের কাছেও কাবার মর্যাদা ও সম্মান সমানভাবে সমাদৃত।

ইসলামের দৃষ্টিতে কাবার মর্যাদা: কাবার ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে শিরকমুক্ত নির্ভেজাল একত্ববাদের ওপর। আল্লাহ বলেন, 'স্মরণ করুন সে সময়কে যখন আমি ইবরাহিমকে আ. বাইতুল্লাহর স্থান নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।' (সুরা হজ, ২৬) আল্লাহ বলেন, 'স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিল: হে আমাদের রব! (এ কাজ) আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন।' (সুরা বাকারা, ১২৭) কাবা শরিফ পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান। আর অপবিত্র কারো সেখানে প্রবেশ করার অধিকার নেই। আল্লাহ বলেন, 'আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আ. আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।' (সুরা বাকারা, ১২৫)

কাবাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। কোরআনের ভাষায়, 'নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় অবস্থিত।' (সুরা আলে ইমরান, ৯৬)

আরও পড়ুন: জাবালে নুর: আজও দীপ্তিময়

বিভিন্ন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, কাবা শরিফ সমগ্র বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ।  বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও বাইতুল্লাহর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আল্লাহ সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।' (সুরা মায়েদা, ৯৭)

ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে কাবাকে কেন্দ্র করেই। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই ও মৃতের দাফন- সব কিছু আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরেই। কাবাগৃহে এক রাকাত নামাজ আদায়ে অশেষ সওয়াব হাসিল হয়।

কাবা শরিফের অবকাঠামো: সৌদি গেজেটের তথ্যানুসারে, কাবাগৃহের উচ্চতা পূর্ব দিক থেকে ১৪ মিটার। (অন্য একটি সূত্র মতে ১২.৮৪ মিটার)। পশ্চিম দিক থেকে ১২.১১ মিটার। উত্তর দিক থেকে ১১.২৮ মিটার। দক্ষিণ দিক থেকেও ১২.১১ মিটার।

ভূমি থেকে কাবার দরজার উচ্চতা ২.৫ মিটার। দরজার দৈর্ঘ্য ৩.০৬ ও প্রস্থ ১.৬৮ মিটার। বর্তমান দরজা বাদশাহ খালেদের উপহার। যা নির্মাণে প্রায় ২৮০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সিলিংকে তিনটি কাঠের পিলার ধরে রেখেছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.। কাবা শরিফের ভেতরের দেয়ালগুলো সবুজ ভেলভেটের পর্দা দিয়ে আবৃত। এই পর্দাগুলো প্রতি তিন বছর পর পরিবর্তন করা হয়। এর ছাদে ১২৭ সে.মি. লম্বা ও ১০৪ সে.মি. প্রস্থের একটি ভেন্টিলেটর রয়েছে, যা দিয়ে ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। এটি একটি কাঁচ দিয়ে ঢাকা থাকে। প্রতিবছর দুবার কাবা শরিফের ভেতরটা ধৌত করার সময় এ কাঁচ খোলা হয়। কাবার প্রথম ছাদ নির্মাতা- কুসাই, অতঃপর কোরাইশ। প্রথম গিলাফ পরিয়েছেন- তুব্বা আবুল আসাদ। প্রথম গোসল দিয়েছেন- মুহাম্মদ (সা.), মক্কা বিজয়ের দিন। প্রথম আজান দিয়েছেন- বেলাল বিন রাবাহ।

কুরাইশদের কাবাগৃহ নির্মাণ: খোজায়া গোত্রের পতনের পর মক্কার শাসনভার গ্রহণ করেন কুরাইশ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুসাই বিন কিলাব। কুরাইশরা ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মক্কার শাসন ও কাবার রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার শাসক হন আবদুল মুত্তালিব। তিনিই প্রথম কাবায় স্বর্ণখচিত লৌহদরজা নির্মাণ করেন। তাঁর শাসনামলে ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা 'সানা'য় প্রতিষ্ঠিত 'কুলাইস গির্জা'কে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য কাবা থেকে হজ স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে কাবা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে বিরাট হস্তীবাহিনী পাঠায়। আল্লাহ তায়ালা তার সমুচিত জবাব দিয়ে দেন। যা পবিত্র কোরআনে সুরা ফিলে বিবৃত হয়েছে। রাসুল সা.-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন এক মহিলা কাবাগৃহে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর বন্যার কারণে কাবার গিলাফ ও দেয়াল ধ্বংস হয়ে যায়। তখন সবার সম্মতিক্রমে কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, কুরাইশরা কাবার উচ্চতা আরও ৯ হাত বৃদ্ধি করে মোট ১৮ হাত (৪৩২ সে.) নির্মাণ করেন এবং তাঁরাই প্রথম কাবার পূর্ণ ছাদ নির্মাণ করেন। আর কাবার পশ্চিম দরজা একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয় এবং পূর্ব দিকের দরজাটি একটু উঁচু করে দেয়া হয়, যাতে অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে। পুরো নির্মাণকাজ বৈধ অর্থে পরিচালিত হয়। এক পর্যায়ে অর্থকষ্টে তাঁরা উত্তর দিকে চিহ্ন রেখে ৭ হাত (৩ মিটার) বাদ দিয়ে দেন। এ ছাড়া তারা পানি নির্গমনের জন্য 'মিজাব' বা নালা তৈরি করেন।

আরও পড়ুন: সব নবী-রাসুল কি হজ করেছেন?

ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার রা. শাসনামলে হুসাইন নামক এক ব্যক্তির মিনজানিক ব্যবহারের দরুণ মতান্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মিনজানিক হামলার কারণে কাবা শরিফ পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে তা পুনর্নিমানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুরাইশদের বাদ দেওয়া 'হাতিম'কে তিনি কাবার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। কাবাকে তিনি পুরো ইববরাহিমি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গমন-বহির্গমনের সুবিধার্থে তিনি 'মাতাফে'র সঙ্গে মিশিয়ে দুটি দরজা নির্মাণ করে সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করে দেন। ছাদের ভারসাম্য রক্ষার্থে তিনি কাবার অভ্যন্তরে তিনটি কাঠের স্তম্ভ স্থাপন করেন এবং কাবার উচ্চতা আরও ১০ হাত বৃদ্ধি করে দেন। ইবনে আসিরের বর্ণনা মতে, এ ঘটনা ছিল ৬৫ হিজরিতে।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্মাণ: ৭৪ হিজরিতে আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন জুবাইর রা.-কে শহীদ করেন। ইবনে জুবাইরের কাবা নির্মাণকে হাজ্জাজ আত্মচিন্তাপ্রসূত জ্ঞান করে কাবাকে কুরাইশি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে উৎসাহী হন। ৯১ হিজরিতে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক কাবাগৃহে ব্যাপক সংস্কার করেন।

 ১০১৯ হিজরিতে কাবার দেয়াল বিদীর্ণ হয়ে গেলে বাদশাহ আহমদ খান তা সংস্কার করেন।

১০৩৯/১০৪০ হিজরি ও ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ বন্যায় কাবার পশ্চিম দিকের দরজাটি ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া কাবার দেয়ালে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ সময় বাদশাহ মুরাদ খান পাশার অর্থায়নে কাবাগৃহে ব্যাপক সংস্কার আনা হয়।

১২৭৬ হিজরিতে বাদশাহ আবদুল মজিদ একটি 'মিজাব' (নালা) হাদিয়া দেন, যাতে ২৩ কেজি (প্রায়) স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়।

সৌদি রাজবংশের সংস্কারকাজ: ১৩৬৩ হিজরিতে বাদশাহ আবদুল আজিজ কাবার দরজা পরিবর্তন করেন। ১৩৭৭ হিজরিতে বাদশাহ সৌদ কাবার ওপরের ছাদ ভেঙে পুনর্নির্মাণ ও নিচের ছাদ নবায়ন করেন। তিনি কাবার দেয়াল নতুন করে মেরামত করেন। ১৩৯১ হিজরিতে বাদশাহ ফয়সাল কাবার দরজায় সংস্কার আনেন। ১৩৯৯ হিজরিতে বাদশাহ খালেদ প্রায় ২৮০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ ব্যবহার করে নতুন দরজা প্রতিস্থাপন করেন।

আরও পড়ুন: তীব্র গরমেও হারামাইনের চত্বর শীতল কেন?

১৪১৬ হিজরিতে বাদশাহ ফাহাদ কাবার বাইরের দেয়াল সংস্কার করেন। ১৪১৭ হিজরিতে তিনি কাবাগৃহের ছাদ, খুঁটি, দেয়ালসহ সব কিছু নতুন করে সংস্কার করেন। ১১-০১-১৪১৭ থেকে শুরু হয়ে ০২-০৭-১৪১৭ হিজরি মঙ্গলবার এ পবিত্র কাজের সমাপ্তি ঘটে। তাঁর এ নির্মাণকাজকে কাবার সর্বশেষ সংস্কার হিসেবে অভিহিত করা হয়।

কাবা বায়তুল্লাহ আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন হিসাবে হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান রয়েছে। এর অনতিদূরেই রয়েছে জমজম কূপ। হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইলের স্মৃতিবিজড়িত এ কাবাঘর। আজও রয়েছে সাফা- মারওয়া পাহাড়। মক্কার মিনাতে বিদ্যমান রয়েছে ইসমাইলের আ. কোরবানির স্মৃতির স্থান। এ গৃহ আদিকাল থেকেই সত্যের সাক্ষ্য হয়ে আছে। আর ইবরাহিমের আ. প্রার্থনা মঞ্জুর করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মক্কাকে শান্তির নগর বানিয়ে রেখেছেন।

তথ্যসূত্র: মক্কার ইতিহাস ও বিভিন্ন লেখা থেকে।

জেবি