ধর্ম ডেস্ক
১৩ মার্চ ২০২৩, ০১:৩৩ পিএম
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং ফরজ বিধান। এই বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, 'মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশে এ গৃহের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।' (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)
তবে, পুরুষের মতো আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্যবান হলেই নারীর ওপর হজ ফরজ হয় না, বরং নারীর জন্য কিছু অতিরিক্ত শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি। যেমন—হজের সফরে স্বামী বা মাহরাম (যে পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হারাম) সঙ্গে থাকা। তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা হলে (পরবর্তী ৩ মাস) ইদ্দত পরিপূর্ণ করা। স্বামী বা মাহরাম সামর্থ্যবান না হলে তার হজের খরচও বহন করা।
হজ যেমন জীবনে একবার করা ফরজ, ওমরা জীবনে অন্তত একবার করা সুন্নত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ওমরা বলা হয়, নিয়ত করে ইহরামসহ কাবা শরিফের চারপাশ সাতবার তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার সাঈ করা এবং মাথা মুণ্ডানোকে।
হজ নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা আবশ্যক হলেও ওমরা পালনের বিশেষ কোনো সময় নেই। হজের নির্ধারিত বিশেষ সময় (৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন) ছাড়া বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় ওমরা পালন করা যায়।
নারীদের হজ-ওমরার নিয়মে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ঋতুমতী নারীরা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছাড়া সাধারণ নারীদের মতোই হজ-ওমরা সম্পাদন করবেন। এখানে ঋতুমতী নারীদের হজ-ওমরার সকল বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১) হজ ও ওমরার জন্য ইহরাম বাধতে পারবেন। ইহরাম না বেঁধে মিকাত অতিক্রম করা জায়েজ নয়। আর ‘ইহরামের আগে গোসল করা মোস্তাহাব।’ (গুনইয়াতুন নাসিক পৃ- ৬৯)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (স.) ইরশাদ করেছেন, কোনো নারী হায়েজ বা নেফাস অবস্থায় মিকাতে পৌঁছলে গোসল করবে এবং ইহরাম গ্রহণ করবে। অতঃপর হজের যাবতীয় কাজ করতে থাকবে। শুধু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ব্যতীত। (সুনানে আবু দাউদ: ১৭৪০)
আরও পড়ুন: রোজা রাখতে অপারগ নারীর সওয়াব কেমন?
২) তালবিয়া পাঠ করতে পারবেন। অনুরূপভাবে যাবতীয় দোয়াও করতে পারবেন। এমনকি কোরআন স্পর্শ না করে মুখস্থ পড়ার অনুমতিও কোনো কোনো ইমাম দিয়েছেন। তবে এ অবস্থায় তাওয়াফ করা ও নামাজ পড়া জায়েজ নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মহিলাগণ হায়েজ বা নেফাস অবস্থায় মিকাতে এলে গোসল করবে এবং ইহরাম গ্রহণ করবে। অতঃপর হজের আমলসমূহ সম্পন্ন করবে শুধু তওয়াফ ব্যতীত। (সুনানে আবু দাউদ: ১/২৪৩)
৩) প্রত্যেক হাজী পুরুষ হোক বা মহিলা, নিজের রমী নিজেই করবে। শরয়ী কোনো ওজর ব্যতীত শুধু ভিড়ের অজুহাতে অন্যের দ্বারা রমী করানো জায়েজ নয়। ‘ঋতুমতী মহিলাগণও রমী করতে পারবে’। (সহিহ বুখারি: ১/২২৩)
৪) নারীর স্রাব চলা অবস্থায় তাওয়াফ করা নিষেধ। তাই পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি যখন মক্কায় পৌঁছলাম তখন আমার হায়েজ চলছিল। আমি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করিনি এবং সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করিনি। তিনি বলেন, তখন আমি এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে অভিযোগ করলাম। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হাজি যে কাজগুলো করে তুমিও তা করতে থাক। শুধু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ পবিত্র হওয়া পর্যন্ত করবে না।’ (সহিহ বুখারি: ১/২২৩)
আরও পড়ুন: ৪ আমলেই নারীর জান্নাত
৫) ঋতুমতী নারী ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে পবিত্র হয়ে গেলে অবশ্যই এর ভেতরে তাওয়াফ সেরে নিতে হবে। যদি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের ভেতর পবিত্র না হয় তাহলে পবিত্র হওয়ামাত্র আদায় করবে। এক্ষেত্রে বিলম্বের কারণে কোনো জরিমানা আসবে না। (রদ্দুল মুহতার: ২/৫১৯)
৬) হজ শুরু করার পর ঋতুস্রাব শুরু হলে এবং ঋতুস্রাব অবস্থায় কেউ তাওয়াফে জিয়ারত ও সাঈ করে ফেললে পবিত্র হওয়ার পর ওই মহিলাকে শুধু তাওয়াফে জিয়ারতই করতে হবে। সাঈ পুনরায় করা জরুরি নয়। তবে এ বিষয়ে যেহেতু মতানৈক্য আছে তাই সম্ভব হলে সাঈও পুনরায় করে নেওয়া ভালো। (গুনইয়াতুন নাসিক: ২৭৩; যুবদাতুল মানাসিক: ৩৭১; রদ্দুল মুহতার ২/৫৫১; আলবাহরুল আমীক: ২/১১২৫)
এখানে উল্লেখ্য, ঋতুস্রাব অবস্থায় তাওয়াফে জিয়ারত ও সাঈ দুটোই নিষেধ করেন কোনো কোনো স্কলার। তবে, তাওয়াফ করার পর হায়েজ শুরু হলে ওই অবস্থাতেই সাফা-মারওয়া সাঈ করতে বাধা নেই। আসলে ‘হায়েজ হজ আদায়ে প্রতিবন্ধক নয়। হায়েজ অবস্থায় যে নারী ইহরাম বাঁধেন তিনি হজের সকল আমল সম্পাদন করবেন; শুধু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ব্যতীত। হায়েজ শেষ হওয়ার পর ও গোসল করার পর তিনি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করবেন। নিফাসগ্রস্ত নারীর হুকুমও একই রকম। যদি ঋতুমতী নারী হজের রুকনসমূহ আদায় করেন তাহলে তার হজ সহিহ।’ (ফতোয়াল লাজনাহ আদ-দায়িমা লিল বুহুস আল-ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা: ১১/১৭২, ১৭৩)
আরও পড়ুন: ঋতুবর্তীসহ ৬ শ্রেণির মানুষের রোজা না রাখার অনুমতি
৭) পবিত্র হওয়ার আগেই দেশে ফিরতে হলে শর্তসাপেক্ষে হায়েজ অবস্থায় তাওয়াফে জিয়ারত করা যাবে। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো— হায়েজ বা নেফাস অবস্থায় থাকার কারণে তাওয়াফে জেয়ারত করতে না পারলে, আর তার দেশে ফেরার সময় হয়ে যায়, কোনোভাবেই তা বাতিল করা বা বিলম্ব করা সম্ভব না হয় তবে এই অপারগতার কারণে সে এ অবস্থাতেই তাওয়াফ করবে। আর এজন্য একটি উট বা গরু জবাই করবে। সাথে আল্লাহর দরবারে ইস্তেগফারও করবে। মোটকথা কোনো অবস্থাতেই তাওয়াফে জিয়ারত না করে দেশে যাবে না। অন্যথায় তাকে আবার মক্কায় এসে তাওয়াফ করতে হবে। যতদিন তাওয়াফ না করবে ততদিন স্বামীর সাথে থাকতে পারবে না। (রদ্দুল মুহতার: ২/৫১৮-৫১৯; মাআরিফুস সুনান: ৬/৩৫৭-৩৫৮)
৮) হায়েজ বন্ধ হওয়ার আগেই ফেরত ফ্লাইটের তারিখ হয়ে গেলে ওষুধ খেয়ে হায়েজ বন্ধ করে তাওয়াফ করা যাবে। যদি শুরু থেকেই ওষুধ-বড়ি খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রেখে কেউ হজের সমস্ত কাজ করেন, তাতেও শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো আপত্তি নেই। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: ১৫/৪৯১; তাতারখানিয়া: ২/৪৭১ ফাতহুল কাদির: ২/৩৩৭ রহিমিয়া: ৮/৮৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর নারী-পুরুষ সবাইকে হজের সকল মাসায়েল জানার, বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।