ধর্ম ডেস্ক
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৩৫ পিএম
মুজেজা হচ্ছে সাধ্যের অতীত বিষয়। যা মহান আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারো পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসুলদের মুজেজা বা অলৌকিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন। যাতে মানুষের ঈমান আনতে আর কোনো প্রশ্ন না থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসুলদের প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সুরা হাদিদ: ২৫)
যুগে যুগে নবী-রাসুলদের মাধ্যমে অনেক মুজেজা প্রকাশ পেয়েছে। আর মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন হলো মহানবী মুহাম্মদ (স.)-এর উপর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেজা। প্রশ্ন হলো- যেখানে মুসা (আ.), ঈসা (আ.) ও সুলাইমান (আ.)-সহ নবী-রাসুলদের চমৎকার সব মুজেজা ছিল, সেখানে কোরআন শ্রেষ্ঠ মুজেজা হয় কীভাবে?
আরও পড়ুন: জাদুকরদের নিজের দলভুক্ত নয় বলে রাজনীতি করেছিল ফেরাউন
মুসা (আ.)-এর হাতের লাঠি সাপ হয়ে বিশ্বসেরা যাদুকরদের সাপ খেয়ে ফেলেছিল, সেই লাঠির আঘাতে সাগরের মাঝখানে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল। ঈসা (আ.) আল্লাহর হুকুমে অন্ধদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতেন। তাঁর হাত লাগলেই কুষ্ঠরোগী সুস্থ হয়ে উঠত। আল্লাহ তাআলা বাতাসকে সুলাইমান (আ.)-এর অধীন করে দিয়েছিলেন। জ্বিনেরা তাঁর কাজ করে দিত। এতসব অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য মুজেজা থাকার পরও পবিত্র কোরআন কীভাবে শ্রেষ্ঠ মুজেজা হয়—এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে। এর ব্যাখ্যা বুঝতে কিছু বিষয় জানতে হবে।
মূলত আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবী-রাসুলকে যুগোপযোগী মুজেজা দান করেছিলেন। যেমন হজরত মুসা (আ.)-এর যুগে জাদুবিদ্যার প্রাধান্য ছিল। জাদুবিদ্যাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হত। কাজেই মুসা (আ.)-এর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাদুসম্রাটদের অসারতা প্রমাণ হলো। যখন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারল যে, এটা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে, তখনই তারা আত্মসংশোধনের উদ্দেশ্যে অনুগত হয়ে গেল। হজরত ঈসা (আ.) আবির্ভূত হয়েছিলেন চিকিৎসা-বিজ্ঞান উৎকর্ষের যুগে। তিনি এমন সব মুজেজা দেখালেন, যা মহান আল্লাহর সাহায্য ছাড়া অসম্ভব। চিকিৎসকগণ কোথায় পাবে জড়পদার্থকে জীবনদানের ক্ষমতা অথবা জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগের সে রকম চিকিৎসার ক্ষমতা? তারাও মহাসত্যের কাছে পরাজিত হলো।
অনুরূপভাবে কবি-সাহিত্যিকদের এক চরম উৎকর্ষের যুগে আবির্ভূত হলেন হজরত মুহাম্মদ (স.)। পবিত্র কোরআনে কারিমের আয়াত শোনে বিশ্বসেরা আরব কবি সাহিত্যিকরা বিস্ময়াভূত হলো। এর সাহিত্য মান ও অলঙ্কারের সামনে নতি স্বীকার করলো। তারা অকপটে স্বীকার করলো, এ মানের সাহিত্য রচনা করা মানব ক্ষমতার বাইরে। সাড়ে ১৪শত বছর আগে কোরআন অবতীর্ণ হলেও সেসময়ের বিশ্ব-পরিস্থিতি, মানব সভ্যতা, মানুষের মানসিকতা, চিন্তা-চেতনাকে সামনে রেখে এই কোরআন যেভাবে তাদের সমস্যাগুলোর সঠিক ও উপযুক্ত সমাধান দিয়েছিল, ঠিক সাড়ে ১৪শত বছর পর আজও সেই একই কোরআন বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সকল সমস্যার সঠিক ও সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান দিয়ে যাচ্ছে। হাজার বছরের ব্যবধানে কত মানুষের জীবন ফুরিয়ে গেছে, এই দীর্ঘ সময়ে কত কী পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এই কালামের একটি অক্ষরও পরিবর্তন হয়নি। রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবিগণ কোরআন থেকে যে পথনির্দেশ দিতেন, এখনও মুসলিমরা সেই কোরআন থেকেই পথনির্দেশ বেছে নিচ্ছেন। এটি কোরআনের এক বিস্ময়কর দিক।
আরও পড়ুন: পবিত্র কোরআনে কার নাম কতবার এসেছে
শুধু যে মুসলমানরা কোরআন থেকে উপকৃত হচ্ছেন তা নয়, এই হেকমতপূর্ণ কোরআন পড়ে উপকৃত হচ্ছেন বড় বড় বিজ্ঞানীরা। অনেক বিজ্ঞানী তো ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে সত্যের অনুগত হয়ে গেছেন। এমনই একজন হলেন বিজ্ঞানী জেফ্রি ল্যাং। তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন যে, এই কোরআন একটি জীবন্ত মিরাকল। তাই তাঁর অন্তরে কোরআন অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি প্রথমেই সুরা বাকারা পড়া শুরু করেন, ‘আলিফ লাম মিম.. এই সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী’ (সুরা বাকারা:২)। প্রথমেই তিনি থমকে যান। আরে, এ যে দেখি আশ্চর্য এক গ্রন্থ! শুরুতেই ঘোষণা দিচ্ছে, তার মধ্যে সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি মনে মনে বললেন, আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।
এরপর তিনি যতই সমানে বাড়তে লাগলেন ততই হতবাক হতে লাগলেন। কোরআনের একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন তিনি। এক জায়গায় বলা হয়েছে, পারলে কোরআনের মতো একটি সুরা নিয়ে আসো। প্রয়োজনে তোমাদের সকল সাহায্যকারীর সাহায্য নাও। জায়গায় জায়গায় বলা হচ্ছে, তারা কি দেখে না? তারা কি বুঝে না? শেষ পর্যন্ত জেফ্রি বললেন, পদে পদে কোরআন আমাকে চ্যালেঞ্জ করে গেল, কিন্তু আমি ভুল তো দূরের কথা, সামান্য গরমিলও খুঁজে পেলাম না। এরপর তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। উইকিপিডিয়ার তথ্যে বলা হয়েছে, জেফ্রি ছিলেন একজন নাস্তিক। আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক জেফ্রি ল্যাং ইসলাম সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য নিবন্ধ এবং তিনটি সেরা বিক্রিত বই লিখেছেন। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলির একটি হলো ইভেন অ্যাঞ্জেলস আস্ক: এ জার্নি টু ইসলাম ইন আমেরিকা।
ড. মরিস বুকাইলির ইসলাম গ্রহণের ঘটনা শুনেননি এমন কম লোকই আছেন। তিনি অনেক বড় এক চিকিৎসা বিজ্ঞানী। বিখ্যাত ‘বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান’ বইটির লেখক তিনি। তিনি ফেরাউনের মমির উপর ফরাসি অধ্যয়নের সিনিয়র সার্জন ছিলেন। ফেরাউনের মমি হওয়ার ঘটনার সঙ্গে পবিত্র কোরআনে তার দেহকে সংরক্ষণ করার বিষয়টি তাকে শেষ পর্যন্ত মুসলিম বানিয়ে দিয়েছে। এরকম ঘটনা একটি-দুটি নয়, অসংখ্য।
যখন কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, অনেক অমুসলিমের অন্তরেও আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। যে সমাজে কোরআন অপরিচিত, সে সমাজের মানুষ যখন হঠাৎ কোরআনের তেলাওয়াত শোনেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকেন। অর্থ না বুঝেই এই অবস্থা হয় শুধুমাত্র সুরে। এমন ঘটনা হরহামেশাই দেখা যায়। এসব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এসব আসলে মহান স্রষ্টার কালামের প্রভাব। একবার রাসুলুল্লাহ (স.) বায়তুল্লাহ শরিফে সুরা নাজম তেলাওয়াত করছিলেন। কাফেররা মুগ্ধ হয়ে তাঁর তেলাওয়াত শুনছিল। যখন সেজদার আয়াত এল, তখন শুধু নবীজি সেজদায় গেলেন না, তারাও সবাই সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। মক্কার কাফেররা প্রকাশ্যে অস্বীকার করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে কোরআন শুনত! এটা কোরআনের ভাষাগত অলৌকিক দিক। আল্লাহ তাআলা এক আয়াতে বলেন, পারলে কোরআনের মতো একটি সুরা বানিয়ে দেখাও। মক্কার কাফেররা এই চ্যালেঞ্জের প্রতিউত্তরে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু পারেনি। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তখনকার আরবরা আরবি ভাষা ও সাহিত্যে খুবই পারদর্শী ছিল, তারপরও তারা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল, এটি একেবারেই অসম্ভব।
আরও পড়ুন: কোরআন যাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না
এসব নিশ্চয়ই পবিত্র কোরআনের জীবন্ত মুজেজার নমুনা। আগেকার নবী-রাসুলদের মুজেজা সেই যুগে শেষ হয়ে গেছে, এখন সেই মুজেজার অস্থিত্ব নেই। আগেকার নবী-রাসুলদের ওপর পাঠানো আসমানি কিতাবও পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন এমন গ্রন্থ, যা কোনোদিন পরিবর্তন হবে না। কারণ এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমিই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা হিজর: ৯)
কোরআনের ব্যাপারে এত বেশি মুজেজা আর নিদর্শন রয়েছে যে, বলে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সুরা মুহাম্মদ: ২৪)। ‘এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে নাজিল হতো, তাহলে তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেতো’ (সুরা নিসা: ৮২)
মনে রাখতে হবে, কোরআনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো—কেউ যদি হেদায়েত খোঁজে, তাহলে সে হেদায়েত পায়, আর যে বিপরীত কিছু খোঁজে, তাহলে কোরআন তা-ই দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ এই কোরআনের মাধ্যমে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন আবার অনেককে পথ প্রদর্শন করেন। এর মাধ্যমে কেবল ফাসেকদেরই পথভ্রষ্ট করে থাকেন। (সুরা বাকারা: ২৬)।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, প্রত্যেক নবীকেই কোনো না কোনো অতুলনীয় নিদর্শন (মুজিজা) দেওয়া হয়েছে, যার ওপর ঈমান আনা হয়েছে কিংবা লোকেরা তাঁর ওপর ঈমান এনেছে। আর আমাকে দেওয়া হয়েছে অহি, যা আল্লাহ আমার ওপর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি যে কেয়ামতের দিন আমার অনুসারীর সংখ্যা তাদের সবার চেয়ে বেশি হবে’ (সহিহ বুখারি: ৭২৭৪)। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এবং সমগ্র মানবজাতিকে পবিত্র কোরআনের মুজেজা বোঝার ও মহাসত্যের কাছে অনুগত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।