images

ইসলাম

যে সংকেত দিয়ে আসে মালাকুল মওত

ধর্ম ডেস্ক

১১ আগস্ট ২০২২, ০৭:০৪ পিএম

প্রত্যেক প্রাণিকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। এটি চিরন্তন সত্য। আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দেবেন বান্দার প্রাণবায়ু বের করে  আনতে। যার মৃত্যু হবে তিনি মালাকুল মওত বা মৃত্যুর ফেরেশতা দেখতে পাবেন। নেককার ব্যক্তির কাছে মৃত্যুর ফেরেশতা আসেন সুশ্রী চেহারা নিয়ে। রহমতের আরও কয়েকজন শুভ্র চেহারাবিশিষ্ট ফেরেশতা জান্নাতের কাফন এবং সুগন্ধি নিয়ে সঙ্গে থাকেন।

আর বদকার লোকের কাছে ফেরেশতা আসেন বিভৎস ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে। সঙ্গে কালো চেহারা বিশিষ্ট আরও কয়েকজন আজাবের ফেরেশতা থাকেন, যাদের সঙ্গে থাকে জাহান্নামের কাফন ও দুর্গন্ধ। এই সময় মুমূর্ষু ব্যক্তির সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। বিকল হয়ে যায় সকল প্রকার প্রতিরোধক্ষমতা। শুরু হয় মৃত্যু যন্ত্রণা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর যন্ত্রণা অনেক কঠিন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৫১০)

মৃত্যুযন্ত্রণা মৃত্যুর বার্তাবাহক
প্রাণবায়ু পায়ের পাতা থেকে শুরু করে গোছা, হাঁটু, পেট, নাভি ও বুক হয়ে কণ্ঠনালির নিচের দুই কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এ সময় মানুষ ক্লান্তি ও অস্থিরতা অনুভব করে এবং এক ধরনের অসহনীয় চাপ অনুভব করে। তখন সে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, এটা তার বিদায়ক্ষণ। আল্লাহ বলেন, ‘কখনো নয়, যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে এবং বলা হবে, কে তাকে রক্ষা করবে? তখন তার প্রত্যয় হবে যে এটা বিদায়ক্ষণ এবং পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাবে। সেদিন তোমার প্রভুর কাছে সব কিছু প্রত্যানীত হবে।’ (সুরা কিয়ামা: ২৬-৩০)
এ আয়াতের ভাষ্য দ্বারা বোঝা যায়, মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যমেই বুঝতে পারবে মৃত্যু সমাগত, বুঝতে পারবে তার পরবর্তী জীবনের পরিণাম কী হবে।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তখন হবে দুনিয়ার শেষ দিন এবং আখেরাতের প্রথম দিনের সম্মিলন। সে সময় দুটি বিপদ একসাথে হাজির হবে। একটি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিপদ, আরেকটি গ্রেফতার হয়ে আখেরাতের জীবনে যাওয়ার বিপদ। তাই পাপী ব্যক্তি খুব পেরেশান থাকবে। (দেখুন: ইবনে কাসির)

বাম অথবা ডান দিকে নাক বেঁকে যাবে। নিম্নের চিবুক ঢিলে হয়ে যাবে। হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে। সারা শরীর শীতল হয়ে যাবে। মৃতের চোখ ঘূর্ণায়মান হয়ে পরে স্থির হয়ে যাবে। উম্মে সালামাহ (রা.) বলেন, নবী (স.) আবু সালামার নিকট এলেন; তখন তার চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। তিনি তার চক্ষু বন্ধ করে বললেন, ‘রূহ কবজ হয়ে গেলে চক্ষু তার দিকে চেয়ে থাকে।’ (মুসলিম: ১৫২৮, ইবনে মাজাহ: ১৪৪৪)

তখন চোখের পর্দা সরিয়ে দেওয়া হবে, তখন সে চারপাশে উপস্থিত ফেরেশতাদের দেখতে পাবে। এখান থেকেই আখেরাত দেখার স্তর শুরু হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমার সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি, এখন তোমার দৃষ্টি প্রখর।’ (সুরা কাফ: ২২)

মৃত্যুযন্ত্রণার কাছে মানুষ অসহায়
ইরশাদ হয়েছে, ‘উপরন্তু কেন নয়—প্রাণ যখন কণ্ঠাগত হয় এবং তখন তোমরা তাকিয়ে থাকো।’ (সুরা ওয়াকেয়া: ৮৩-৮৪)
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ মৃত্যুযন্ত্রণার একটি সাধারণ চিত্র অঙ্কন করেছেন। যেখানে মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। যেন বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা নিজেদের অবস্থা লক্ষ করো। যখন জীবন তোমাদের কণ্ঠনালিতে চলে আসে এবং তোমরা কঠিন অবস্থায় পতিত হও, তখন তোমাদের আপনজনরা পাশে থেকেও কোনো উপকার করতে পারে না।

মুমিন ও পাপী উভয়ের জন্যই মৃত্যুযন্ত্রণা
মৃত্যুযন্ত্রণা কম-বেশি সবাইকে ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ: ১৯)
কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় মৃত্যু ও মৃত্যুযন্ত্রণা অনিবার্য। মুমিন ব্যক্তি মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে হয়তো তার গুনাহ মাফের জন্য অথবা মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। আর অবিশ্বাসীদের মৃত্যুযন্ত্রণা হয় পরবর্তী জীবনের শাস্তির সূচনা হিসেবে।

পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় মুমিন ও পাপী সবাই মৃত্যুযন্ত্রণার শিকার হবে। পাপীদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করে তাদের প্রাণহরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’ (সুরা আনফাল: ৫০)

‘ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমণ্ডল এবং পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে তাদের প্রাণ হরণ করবে তখন তাদের কী দশা হবে? (সুরা মুহাম্মদ: ২৭)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে পেতে যখন অবিচারকারীরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের করো। তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্পর্কে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে। সে জন্য আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম: ৯৩)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারী ও পাপিষ্ঠদের মৃত্যুযন্ত্রণার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। আলেমরা বলেন, মৃত্যুযন্ত্রণা অবিশ্বাসীদের সেভাবে নাড়িয়ে দেয় যেমন সমুদ্রের ঢেউ ফেনাকে নাড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: যে তিন অভ্যাস থাকলে জাহান্নাম নিশ্চিত 

মৃত্যুর ফেরেশতা পাপী ব্যক্তির রুহ নেওয়ার সময় বলবেন, হে নিকৃষ্ট আত্মা! তুমি আগুন ও জাহান্নামের এবং ক্রোধান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ রবের উদ্দেশে বের হয়ে আসো। তখন তার অভ্যন্তরীণ চেহারা কালো হয়ে যাবে এবং চিৎকার করে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে পুনরায় পাঠান যাতে আমি সৎকাজ করি, যা আমি পূর্বে করিনি।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৯)

অন্যদিকে কোরআনে একজন মুমিনের মৃত্যুর দৃশ্য এভাবে তুলে ধরা হয়—‘(মৃত্যুর পরপর) তাকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলে উঠল, হায় আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারত—কিভাবে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।’ (সুরা ইয়াসিন: ২৬-২৭)
উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত লোকটিকে শহিদ করে দেয়া হয়েছিল। কেননা, কেবল জান্নাতে প্ৰবেশ অথবা জান্নাতের বিষয়াদি দেখা মৃত্যুর পরই সম্ভবপর। (দেখুন: কুরতুবি, ফাতহুল কাদির) কাতাদাহ (রহ) বলেন, এ লোকটি তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহবান জানিয়েছে এবং তাদের জন্য উপদেশ ব্যক্ত করেছে, কিন্তু তারা তাকে হত্যা করেছে। (তাবারি)

সবচেয়ে কম মৃত্যুযন্ত্রণা হবে শহীদের
অবিশ্বাসী ও পাপীদের তুলনায় মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই হালকা হবে। আর সবচেয়ে কম মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবে আল্লাহর রাস্তার শহীদরা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের কাউকে পিঁপড়া কামড়ালে যতটুকু কষ্ট অনুভব করো, শহিদের নিহত হওয়ার কষ্ট তার চেয়ে বেশি হবে না।’ (সুনানে নাসায়ি: ৩১৬১)

মর্যাদাবৃদ্ধির জন্য মুমিনকেও যন্ত্রণা দেওয়া হয়
রাসুলুল্লাহ (স.) আয়েশা (রা.)-এর কাছে উপস্থিত হন। তখন তাঁর এক নিকটতম প্রতিবেশী মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। নবী (স.) তাকে চিন্তিত দেখে বলেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর কারণে তুমি চিন্তিত হয়ো না। কেননা এটা সৎকর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৫১)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা তার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো মুমিনের জন্য কোনো মর্যাদার স্তর নির্ধারণ করেন এবং নিজ আমল দ্বারা যদি তা অর্জন করতে না পারে, তখন আল্লাহ তাঁর শরীর বা তাঁর সম্পদ অথবা তাঁর সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর মুমিন ধৈর্যধারণ করার ফলে সে পূর্বনির্ধারিত মর্যাদার স্তরে পৌঁছে যায়।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩০৯০)

আরও পড়ুন:ইবলিস কোন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আদমকে সেজদা করেনি?

যে দোয়ায় মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হয়
মৃত্যুশয্যায় মহানবী (স.) মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হওয়ার জন্য দুটি দোয়া করেন। তা হলো—ক) ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৯৭৮)

খ) ‘হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৭৪)

মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা মুমিনদের জন্য আবশ্যক। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকে তাঁর আদেশ-নিষেধ কী, সেটাও জানেন না। কারণ তারা কোরআন-সুন্নাহ নিয়ে পড়াশোনা করেন না। শুধু শোনা কথার উপর তর্ক-বিতর্ক করেন আর সংশয়বাদীতে পরিণত হন। আল্লাহ সবাইকে হেদায়াত করুন। ক্ষমা করুন। 

আল্লাহ তাআলা বান্দাকে মৃত্যুর দিন সম্পর্কে সজাগ করে বলেন, প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর কেয়ামতের দিন তোমাদের পরিপূর্ণ বদলা দেওয়া হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা আল ইমরান: ১৮৫)

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘তিনি জীবনদান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই, কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সুরা তাওবা: ১১৬)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন এবং ঈমান নিয়ে মৃত্যু নসিব করুন। আমিন।