ধর্ম ডেস্ক
১০ আগস্ট ২০২২, ০১:৩৬ পিএম
সৌদি আরবের মদিনা মুনাওয়ারা। পবিত্র ও শান্তিময় এক শহর। মদিনা নামটি শোনামাত্রই মুমিনের হৃদয়ের আয়নায় ভেসে ওঠে এক স্বর্গীয় নগরীর ছবি। প্রেম, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধে ভরে যায় মন। এখানেই মসজিদে নববি। সবুজ গম্বুজের নিচে শায়িত দো-জাহানের মহান নেতা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)। তাঁকে ধারণ করে চীরধন্য মদিনা শহর।
সমতল ও সবুজের আলপনা আঁকা নান্দনিক সৌন্দর্যে আলোকিত পবিত্র মদিনা। কোলাহলহীন নগরী। এই শহরে পা দিলে মন-প্রাণ শিহরিত হয়ে ওঠে। হৃদয়পটে এক প্রশ্ন উঁকি দেয়- এটি কি সেই মদিনা? যেই নগরের মানুষ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নবীজিকে বরণ করতে ছুটে গিয়েছিলেন শহরের শেষ প্রান্তে। শিশুরা গেয়ে ওঠেছিল- তালাআল বাদরু আলাইনা অর্থাৎ সূর্য উদিত হয়েছে আমাদের ওপর।
দিনে ও রাতে আলাদা সৌন্দর্যে আবির্ভূত হয় মদিনা শহর। পৃথিবীর উন্নত শহরের মানুষগুলোও মদিনার অপার সৌন্দর্যে অবাক হন। বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিময় শহর। মদিনার সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে, বিশ্বের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর শহরের মর্যাদা পেয়েছে শহরটি। স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে এই স্বীকৃতি। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্বাস্থ্যকর শহরের যেসব বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তার সবকটি পূরণ করেছে মদিনা। এর ভিত্তিতেই এটিকে স্বাস্থ্যকর শহরের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জরিপ কাজে অংশ নিয়েছে ২২টিরও বেশি সরকারি, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

মদিনা শহরের আয়তন প্রায় ৫৮৮ বর্গকিলোমিটার। ২০২০ সালের এক হিসেবে, শহরটির মোট জনসংখ্যা ১৪ লাখ ৮৮ হাজার। মদিনা সৌদি আরবের পশ্চিমের অঞ্চল হেজাজের শহর এবং আল-মদিনাহ প্রদেশের রাজধানী। সাগর পিট হতে ৬ শত মিটার উপরে পবিত্র মদিনা। এখানকার পানি হালকা শীতল ও সুমিষ্ট। শহরের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে গরম, শীতকালে ঠাণ্ডা।
রাসুলুল্লাহ (স.) মাতৃভূমি মক্কা থেকে ৬২২ সালে সাহাবি আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে পবিত্র মদিনায় হিজরত করেন এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শেষ ১০টি বছর এই শহরেই কাটান। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সেই স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে ইসলামি বর্ষপঞ্জি হিজরি সাল চালু হয়। হিজরতের পরে নবীজি (স.) এর উপর নাজিল হওয়া সুরাগুলোকে বলা হয় মাদানি সুরা। মদিনার প্রাণকেন্দ্র মসজিদে নববি থেকেই খোলাফায়ে রাশেদিন অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছেন। মসজিদে নববি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর প্রথম দিন থেকে তা বেশি হকদার যে, তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা তাওবা: ১০৮)

হিজরতের বছর নির্মিত মসজিদে নববি আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের এক অনুপম নিদর্শন। অপরূপ কারুকার্য, আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যেকোনো লোককেই মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। মসজিদে নববির খোলা প্রাঙ্গণে স্তম্ভের শীর্ষভাগে ছাতাগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে যখন বন্ধ থাকবে, তখন স্তম্ভের একটি অংশই মনে হয়। কিন্তু যখন রোদ ওঠে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধীরে ধীরে ছাতা খুলে যায়। সবুজ গম্বুজের নিচে প্রিয়নবী (স.)-এর রওজা মোবারক এবং এর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হজরত আবু বকর ও হজরত ওমর (রা.)। একাধিক হাদিস সূত্রে জানা যায়, মসজিদে নববিতে নামাজ আদায় করলে প্রতি রাকাতে ১০ হাজার, ২৫ হাজার অথবা ৫০ হাজার রাকাতের সওয়াব হয়। এছাড়াও নবী কারিম (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে আর কোনো নামাজ কাজা করেনি, সে মোনাফেকি থেকে মুক্ত হবে এবং দোজখের আজাব থেকে নাজাত পাবে।
মক্কা থেকে মদিনার অবস্থান উত্তর দিকে। মসজিদে নববির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। মসজিদে নববির দক্ষিণ-পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বলা হয় বাবে জিবরাইল, যেখানে জিবরাইল (আ.) দাহিয়া কালবি (রা.)-এর বেশ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (স.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্থান হলো রিয়াজুল জান্নাহ বা বেহেশতের বাগান। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান।
মসজিদে নববির ঐতিহাসিক ও বিশেষ ফজিলতপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে আরও আছে রহমতের স্তম্ভ, সুবাস স্তম্ভ, আয়েশা স্তম্ভ, তওবা স্তম্ভ ও মসজিদে নববির পাশে ‘জান্নাতুল বাকি’ গোরস্থান। এই গোরস্থানে হজরত ফাতেমা ও হজরত ওসমান (রা.)-সহ অগণিত সাহাবায়ে কেরামের কবর রয়েছে।
এছাড়াও এই শহরে রয়েছে মদিনার প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কুবা’ ও কিবলা পরিবর্তনের মসজিদ ‘মসজিদে ক্বিবলাতাইন’। সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি এবং মসজিদে আকসার পরই মসজিদে কুবার স্থান। হাদিসে আছে, মসজিদে কুবাতে নামাজ আদায় করলে এক ওমরাহর সওয়াব হয়। (তিরমিজি: ২২৪; ইবনে মাজাহ: ১৪১১)
দুই কিবলার মসজিদ বা মসজিদে কিবলাতাইন হচ্ছে যেই মসজিদে নামাজ পড়াকালীন সময়ে আল্লাহর নির্দেশে প্রিয়নবী (স.) কেবলা পরিবর্তন করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে এই মসজিদটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আছে ওহুদ পাহাড়। পাহাড়টি মদিনা শহরের উত্তরে ১০৭৭ মিটার বা ৩হাজার ৫৩৩ ফুট উঁচু। এই পাহাড়ের পাদদেশে মক্কার কুরাইশ ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে বিশ্বনবী (স.) আহত হন এবং তাঁর একটি দাঁত ভেঙে যায়। এই যুদ্ধে হজরত হামজা (রা.)-সহ ৭০ জন সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন। ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাঁদেরকে দাফন করা হয়।
মদিনার এসব স্থানগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ স্থানগুলোর প্রতি মুসলিম উম্মাহর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আজন্ম। যা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মদিনার রাস্তা এমন ছিলো না। তখনকার দিনে এই পথ ছিলো দুর্গম। অবাক লাগে, রাসুলুল্লাহ (স.) হিজরতে সময় ও পরে সাহাবাসহ কীভাবে এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন!
আরও পড়ুন: পবিত্র কাবাঘরের ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলোতে মদিনার অনেক নাম পাওয়া যায়, যা শহরটির মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। আল্লামা সামহুদি মদিনার ৯৪টি নাম উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ‘মদিনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা কোরআনে একাধিকবার এসেছে। হাদিসেও এই নামের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, তাবাহ ও তাইবাহ নামেও অভিহিত করা হয়েছে মদিনাকে। শব্দ দুটোর অর্থ উত্তম। উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি নামের মধ্যে রয়েছে আদ-দার, আল-হাবিবা, দারুল হিজরা ও দারুল ফাতহ।

রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনায় আসার আগে এর নাম ছিল ইয়াসরিব। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নূহ (আ.)-এর সপ্তম অধস্তন পুরুষ আসরিব ইবনে কানিজাহর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল ইয়াসরিব। তাদেরকে আমালেকা বা আমালিক বলা হত। পরবর্তীতে হেজাজ, শাম, বাহরাইন ও মিশরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। আমালেকা বংশের পর এই ভূমিতে ইহুদিরা এসে বসতি স্থাপন করেন। এছাড়া পবিত্র মদিনায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরাও বসবাস করতেন। ইয়ামেন থেকে আসা আওস ও খাজরাজ বংশের লোকদেরকেও পবিত্র মদিনার প্রাচীন অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়।
মূলত আওস ও খাজরাজ আনসাররাই ইসলামের দিকে অগ্রগামী হয়েছিলেন। মদিনার এই মানুষগুলো মক্কার কুরাইশদের বিপরীতে নম্র স্বভাব ও কোমল প্রকৃতির ছিলেন। কঠোরতা, অহংকার, সর্বোপরি সত্য প্রত্যাখ্যানের মত নিচু স্বভাব হতে তাঁরা ছিলেন পুত পবিত্র। মহানবী (স.)-এর হিজরতের পর এই নগরীর নাম রাখা হয় মদিনা। মদিনা শব্দের অর্থ শহর। এখানকার সকল ধর্মবিশ্বাস ও গোত্রের অধিবাসীরা শান্তির দূত ও অভিভাবক হিসেবে মুহাম্মদ (স.)-কে সানন্দে মেনে নেন। তাঁর আগমনে উৎফুল্ল জনতা নিজেদের শহরের নাম বদলে রাখেন মদিনাতুননবী বা নবীর শহর।

মক্কা শরিফের মতো পবিত্র মদিনারও সীমানা রয়েছে। মদিনা মুনাওয়ারার দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী ওই সীমানায় তিন ইমামের মতে, গাছ কাটা ও শিকার করা যাবে না। ইমাম আবু হানিফার মতে, গাছ কাটা ও শিকার করা নিষিদ্ধ নয়, তবে মর্যাদার দিক দিয়ে পবিত্র মক্কার মতো মদিনা মুনাওয়ারাও কোনো অংশে কম নয়।
মহানবী (স.) মদিনায় বরকত নাজিলের জন্য দোয়া করেছেন। বলেন, হে আল্লাহ! মক্কা মোকাররমায় তুমি যা বরকত দান করেছ, মদিনা মুনাওয়ারায় তার দ্বিগুণ বরকত দান করো। (সহিহ মুসলিম: ৩৩৯২)। রাসূলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারতের জন্য এল এবং এছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য শাফায়াত করা আমার ওপর হক বা কর্তব্য হয়ে গেল। (আল মুজামুল কাবির: ১৩১৪৯)
ইবনে কাসিরের বর্ণনায় এসেছে, খলিফা ওমর (রা.) দোয়া করতেন এভাবে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনার পথে শহিদ হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন এবং আপনার রাসুল (স.) এর শহরে আমাকে মৃত্যু দিন’।
মদিনার বসতি বিস্তৃত হয়ে একসময় ইহাব অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে বলে হাদিসের বর্ণনায় পাওয়া যায়। আরেক বর্ণনায় আছে, বিস্তৃত সীমানাটি হবে খায়বরের নিকটবর্তী সালাহ নামক জায়গা। হাদিসে আরও আছে, দাজ্জাল মক্কা-মদিনায় ঢুকতে পারবে না, আর না কোনো মহামারি। মক্কা ও মদিনার প্রতিটি প্রবেশপথে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারারত থাকবেন। মদিনা শরিফ তিনবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে। এতে সেখান থেকে সব কাফের ও মুনাফিক বের হয়ে যাবে। রাসুল (স.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই (কেয়ামতের আগে) ইমান মদিনা মুনাওয়ারার দিকে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করবে, যেমন সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ (বুখারি: ১৮৭৬)

মদিনা পৃথিবীর এমন শহর, যা বারবার দেখার পরও তৃপ্তি মেটে না। মদিনা দেখে আসা মানুষের বর্ণনায় খেয়াল করবেন, অতৃপ্তির এক কালো ছায়া তাদের মনে। আসলে মদিনার জায়গাগুলো এতটাই সুন্দর, মনোরম, গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক যে, বারবার দেখার পরও মুসলিম মনন অতৃপ্তই থেকে যায়। মুসলমানের জীবনে আল্লাহর ঘর জিয়ারত ও প্রিয়নবী (স.)-এর রওজা মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম জানানোর চেয়ে বড় প্রাপ্তি হতে পারে না। এই প্রাপ্তির বর্ণনা দেওয়া মুশকিল, এটি অনুভবের! দৃষ্টিগোচর হতেই মন শীতল হয়ে যায়। আনন্দ ও আবেগে অশ্রুসজল চোখে বিমুগ্ধ তাকিয়ে থাকার মধ্যে যেন এক স্বর্গীয় প্রশান্তি! পৃথিবীর সকল মদিনাপাগলকে আল্লাহ তাআলা পবিত্র মদিনা সফরের তাওফিক দান করুন। আমিন।