ধর্ম ডেস্ক
০৮ আগস্ট ২০২২, ০৫:৪০ পিএম
আদম (আ.)-কে সেজদা করার নির্দেশ অমান্য করেছিল ইবলিস। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অমান্য করার কারণে শয়তানে পরিণত হয়েছে সে। এর আগে শয়তান বলতে কেউ ছিল না। তাহলে তাকে কে ধোঁকা দিয়েছিল? এই প্রশ্নটি কিছুদিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি আসলে কোনো প্রশ্নই নয়। এটি হচ্ছে সংশয়বাদীদের জন্য একটি ধোঁকা।
যে-কেউ নফসের কুমন্ত্রণায়ও যে পড়তে পারে, তারা এই সহজ বিষয়টি জানে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের পালনকর্তার কাছে, মানুষের অধিপতির কাছে, মানুষের মাবুদের কাছে- কুমন্ত্রণাদানকারী অনিষ্ট থেকে, যে গা ঢাকা দেয়। যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। জিনদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে।’ (সুরা নাস: ১-৬)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।’ (সুরা ক্বাফ: ১৬)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় নাফস মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে।’ (সুরা ইউসুফ: ৫২)
সুতরাং শয়তান যেভাবে কুমন্ত্রণা দিতে পারে, তেমনিভাবে নফসও কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (স.) নফসের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাই, আমার নফসের অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্ট থেকে এবং তার শিরক (বা জাল) থেকেও।’ (আবু দাউদ: ৫০৬৭; তিরমিজি: ৩৩৯২, মুসনাদে আহমদ: ১/৯)
নফসের ধোঁকার ভিত্তি হলো - চিন্তা ভাবনা ও যুক্তি। আর শয়তান তার নিজস্ব যুক্তিভিত্তিক ধোঁকায় পরে আদমকে সেজদা করা থেকে বিরত থেকেছিল । এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।' (সুরা আরাফ: ১২)
আরও পড়ুন: আপনি কি অহংকারী? যেভাবে বুঝবেন
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ইবলিস ছিল জ্বিন জাতীর অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তাআলা মানুষ ও জ্বিনকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। অর্থাৎ চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, কর্ম অনুযায়ী পরকালে তাদের বিচার হবে। ‘হে মানুষ ও জ্বিন! অচিরেই তোমাদের (হিসাব নিকাশের) প্রতি মনোনিবেশ করব।’ (সুরা রহমান: ৭৮)
ইবলিস যেহেতু জ্বিন, তাই সে নফসের ধোঁকায় পড়ে তার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে অহংকার করেছে। অর্থাৎ তার মনে হয়েছে, মাটির তৈরি মানুষকে সেজদা করা শোভনীয় হবে না। কিন্তু সে তার এই অহংকারী মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করেছে যে, স্বয়ং স্রষ্টার আদেশই অমান্য করে বসল।
সবারই মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘..আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সুরা দাহার: ২-৩)। ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য পুরস্কার হিসেবে রয়েছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্য যে তার প্রতিপালককে সমীহ করে।’ (সুরা বাইয়্যিনাহ: ৭-৮)
আরও পড়ুন: দুনিয়াতেও শাস্তি পেতে হয় অহংকারী ব্যক্তিকে
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ইবলিসের পূর্ণ ধারণা ছিল। মহাশক্তিধর ও সম্মানের অধিকারী আল্লাহর অস্তিত্ব যে কত ব্যাপক, তিনি কত ক্ষমতাবান এবং তাঁর তুলনায় ইবলিস কত দুর্বল এক মামুলি সৃষ্টি—এসব তার খুব ভালোভাবে জানা ছিল। এমনকি আল্লাহ তাআলা তার সঙ্গে কথা বলেছেন। এত মর্যাদা পাওয়ার পরেও, সবকিছু জানার পরেও, সে আল্লাহর আদেশের উপর সোজা ‘না’ করে দিল শুধুমাত্র অহংকারের কারণে। তার নফস তাকে অহংকারী করে তুলল। কিন্তু অহংকার করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলার। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সেদিন তার যে কথোপকথন হয়েছিল, তা পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে এভাবে—
‘ইবলিস, যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি তুমি অনুগত হতে পারলে না কেন? তুমি কি তখন অহংকার করছিলে, নাকি তুমি নিজেকে মহিমান্বিতদের একজন মনে করো?’ (সুরা সাদ: ৭৫)
স্রষ্টার কাছ থেকে এত কঠিন একটা প্রশ্ন সরাসরি শোনার পরে স্বাভাবিকভাবেই ইবলিসের উচিত ছিল সঙ্গেসঙ্গে ক্ষমা চাওয়া এবং স্বীকার করা যে, সে বড় ভুল করে ফেলেছে, তাকে মাফ করে দেওয়া হোক। কিন্তু সে তা না করে উলটো আল্লাহকে বোঝানোর ঔদ্ধত্য দেখাল, ‘সে বলল, ‘আমি ওর থেকে বড়। আপনি আমাকে আগুন থেকে বানিয়েছেন, আর ওকে বানিয়েছেন মাটি থেকে।’ (সুরা সাদ: ৭৬)
ইবলিস শুধু আল্লাহর সঙ্গে যুক্তিতর্কই করেই শেষ করেনি, তার মধ্যে কখনোই কোনো ধরনের অনুশোচনাও ছিল না। এমনকি পৃথিবীতে নির্বাসিত হওয়ার পর এই বলে সে প্রতিজ্ঞা করল যে, যে মানবজাতির সৃষ্টি নিয়ে আজ তার এই অবনমন, সেই মানবজাতিকে কেয়ামত পর্যন্ত সে বিভ্রান্ত করে যাবে। ইবলিসের এই মানসিকতা কিছু মানুষের মধ্যেও আছে। চিরকালের জন্য জাহান্নামে যেতেও রাজি, তারপরেও মহান আল্লাহর কাছে মাথা নত করবে না। ধ্বংস তাদের জন্য।
‘ধ্বংস তাদের যারা আল্লাহর সাথে শরিক করে’ (সুরা হা-মীম সাজদাহ: ৬)। ‘ধ্বংস হোক তারা যারা আন্দাজে কথা বলে’ (সুরা জারিয়াত: ১০)। ‘ধ্বংস তাদের যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণ হতে কঠোর হয়ে গেছে’ (সুরা জুমার: ২২)। ‘ধ্বংস ওই সকল কাফিরদের যারা ধারণা করে আসমান, জমিন ও এর মাঝে যা কিছু আছে, আল্লাহ সেগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা সাদ: ২৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মহান আল্লাহর প্রত্যেকটি আদেশ যুক্তি-তর্ক ছাড়াই মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।