ধর্ম ডেস্ক
০৩ আগস্ট ২০২২, ০১:০৯ পিএম
বন্ধুত্ব এমন একটি সামাজিক বন্ধন, যা মানুষকে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। মানুষের জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। আরবিতে বন্ধুকে বলা হয়- ‘খলিল’। যেহেতু মানুষ বন্ধু ছাড়া চলতে পারে না; সেহেতু বন্ধু গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। এ প্রসঙ্গে নবীজি (স.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতি অনুসরণ করে। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (আবু দাউদ: ৪৮৩৩)
সৎ এবং পরহেজগার বন্ধু নির্বাচন প্রসঙ্গে কোরআন ও হাদিসে বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী।’ (সুরা তাওবা: ৭১)
এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যারা ঈমানদার, ধর্মপ্রাণ, সত্যবাদী, সদাচারী, সৎকাজে অভ্যস্ত এবং নীতিবান। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসল, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করল, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করল এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকল, সে ব্যক্তি নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল।’ (আবু দাউদ: ৪৬৮৩)
ইসলামি স্কলারদের মতে, যারা মহান আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, তাঁর খাতিরে সমবেত হয়, পরস্পরের খবরাখবর নেয় ও পারস্পরিক যোগাযোগ বহাল রাখে, আল্লাহর ভালোবাসাই তাদেরই প্রাপ্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘এক ব্যক্তি তার কোনো (মুসলমান) ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওনা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। অতঃপর তিনি এ-ও বলেন যে, (ফেরেশতা তাকে বলেন) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস।’ ( মুসলিম: ২৫৬৭)
আরও পড়ুন: হাশরের মাঠে কার কী অবস্থা হবে?
বন্ধুত্বের পার্থক্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উপমা হলো কস্তূরী বহনকারী (আতর বিক্রেতা) ও কামারের হাপরের মতো। মৃগ কস্তূরী বহনকারী হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে বা তার কাছ থেকে তুমি কিছু খরিদ করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি লাভ করবে সুবাস। আর কামারের হাপর তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, নয়তো তার কাছ থেকে পাবে দুর্গন্ধ।’ (বুখারি: ৫১৩৬)
ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুত্ব যেমন উপযুক্ত লোকের সঙ্গে করা উচিত, সারাজীবন ওই বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য চেষ্টা করাও উচিত। পারস্পরিক সামাজিক সৌজন্য চর্চা করা, দাওয়াত দিলে রক্ষা করা, দয়ার বিনিময়ে দয়া জানানো, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, খাটো বা বিদ্রূপ না করা, অসুখ বিসুখে দেখতে যাওয়া ইত্যাদি বন্ধুর অধিকার এবং বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়। এসবের গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। প্রত্যেকটা কাজই নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত।
হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির আশায় কোনো অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা কোন ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলা। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে।’ (তিরমিজি: ২০০৮; সহিহুল জামে: ২১৬৩; মেশকাত: ৫০১৫)
আরও পড়ুন: হাশরের মাঠ দেখতে কেমন হবে?
স্বার্থের জন্য, জাতিগত বা দলগত পরিচয়ের ভিত্তিতে যেসব বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সেসব বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাই বন্ধুত্ব নির্বাচনে সাবধান হতে হবে। স্বার্থ ছাড়া মুসলিম ভাইকে ভালবাসা একটি বড় ইবাদত এবং ঈমানের দাবী। রাসুল (স.) মুমিনদের উদাহরণ দিয়েছেন একটি দেহের মতো, একজন ব্যক্তির মতো অথবা একটি দালানের মতো। যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। আবার কোন কারণে শরীরের কোন অঙ্গ অসুস্থ হলে পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। (বুখারি:৪৮১; মুসলিম: ২৫৮৬; মেশকাত: ৪৯৫৫)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সঙ্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে অবচেতন করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহাফ: ২৮)
মনে রাখতে হবে, অনেক সময় চরম শত্রুও বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে এসে ভীষণ সর্বনাশ করে। ইবলিশ শয়তানও হজরত আদম (আ.)-এর কাছে বন্ধুর বেশে এসে তাদের ধোঁকায় ফেলেছিল। তাই ইসলামে বন্ধু নির্বাচন একটি বড় বিষয় এবং 'ভুল বন্ধু' হাশরের মাঠে আফসোসের কারণ হবে। সেদিন তারা কীভাবে আফসোস করবে সেটাও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্ৰহণ না করতাম!’ (সুরা ফুরকান: ২৮)
সুতরাং ভালো গুণের অধিকারী ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করাই মুসলমানের কাম্য। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেককে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।