ধর্ম ডেস্ক
২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:০৯ পিএম
ইসলামে নামাজের জন্য শারীরিক ও আত্মিক পবিত্রতা অপরিহার্য। অনেক মুসল্লির জীবনে একটি সাধারণ ও অস্বস্তিকর সমস্যা হলো- অজুর পর বা নামাজের সময় প্রস্রাবের ফোঁটা পড়ার সন্দেহ হওয়া। এটি প্রায়ই মানসিক অস্থিরতা বা ‘ওয়াসওয়াসা’ সৃষ্টি করে এবং ইবাদতে মনোযোগ নষ্ট করে। অথচ ইসলামি শরিয়াহ এ ধরনের সংশয়ের জন্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত সমাধান দিয়েছে।
অনেক সময় অজু বা নামাজের পর হঠাৎ মনে হয়- বোধহয় এক ফোঁটা প্রস্রাব বের হলো। কিন্তু যাচাই করলে কোনো আলামত পাওয়া যায় না। ইসলামি ফিকহি মূলনীতি হলো- ‘নিশ্চয়তা কখনো সন্দেহ দ্বারা বাতিল হয় না’ (আল-আশবাহ ওয়ান নাজায়ের)। অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত চোখে দেখা বা স্পষ্ট আলামত না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ নিছক সন্দেহের কারণে অজু ভাঙবে না বা পোশাক অপবিত্র হবে না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াতে চাও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত কর...।’ (সুরা মায়েদা: ৬) এই আয়াত পবিত্রতার গুরুত্ব বহন করে। তবে সন্দেহের কারণে ইবাদত ছেড়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
এ বিষয়ে হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট সমাধান রয়েছে। ‘রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হল যে, তার মনে হয়েছিল যেন সালাতের মধ্যে কিছু হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, সে যেন ফিরে না যায়, যতক্ষণ না শব্দ শোনে বা দুর্গন্ধ পায়।’ (সহিহ বুখারি: ১৩৭)
আরও পড়ুন: নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হতে যেভাবে অজু করবেন
অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ ছাড়া কেবল অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে নামাজ ছাড়া যাবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি হেকমতপূর্ণ সমাধান পাওয়া যায় হাদিসে। সেটি হলো সন্দেহ হলে পানি ছিটিয়ে দেওয়া। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তুমি অজু করার পর তোমার লজ্জাস্থানে পানি ছিটিয়ে নেবে। অতঃপর যদি আর্দ্রতা অনুভব হয়, তবে সেটাকে ছিটানো পানির আর্দ্রতা বলে মনে করবে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ৫৮৩)
যদি প্রস্রাব ঝরে পড়ার সন্দেহ হয়, এই উপায়টি সন্দেহ ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচার উত্তম উপায়।
ইসলামি ফিকাহ অনুযায়ী, শুধুমাত্র সন্দেহ বা মনের খুতখুতানির কারণে অজু ভঙ্গ হয় না বা জামা অপবিত্র হয় না। অজু ভঙ্গের জন্য প্রস্রাবের ফোঁটা কাপড়ে বা শরীরে লেগে থাকার নিশ্চিত প্রমাণ আবশ্যক। তবে যারা দীর্ঘমেয়াদী প্রস্রাব ঝরা বা ফোটা পড়ার সমস্যায় ভুগছেন, শরিয়তের পরিভাষায় তাদের ‘মাজুর’ বলা হয়। মাজুর ব্যক্তির বিধান সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন ও সহজ।
আরও পড়ুন: অজুর বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি তখনই ‘মাজুর’ হিসেবে গণ্য হবেন, যখন কোনো একটি নামাজের পূর্ণ ওয়াক্ত (শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত) এমনভাবে অতিবাহিত হয় যে, অজু করে ফরজ নামাজটুকু পড়ার মতো সময়ও তিনি পবিত্র অবস্থায় পান না। একবার মাজুর সাব্যস্ত হলে, পরবর্তীতে প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার সেই সমস্যা দেখা দিলেই তিনি মাজুর হিসেবে গণ্য থাকবেন।
মাজুর ব্যক্তি প্রতি নামাজের ওয়াক্তে একবার অজু করবেন এবং ওই অজু দিয়ে ওই ওয়াক্তের মধ্যে যত ইচ্ছা নামাজ (ফরজ, সুন্নত, নফল) ও কোরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন। রক্ত, পুঁজ বা প্রস্রাব বের হতে থাকলেও তার অজু নষ্ট হবে না। তবে ওয়াক্ত শেষ হলে নতুন ওয়াক্তের জন্য পুনরায় ওজু করতে হবে। (হাশিয়াতুত তাহতাবি আলা মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা ১৪৮–১৫১)
১. পবিত্রতা অর্জন: ইস্তিঞ্জা বা শৌচকর্ম শেষে একটু সময় নিন, তাড়াহুড়ো করবেন না। টিস্যু ব্যবহার করে নিশ্চিত হোন।
২. পানি ছিটানো (ইনতিদাহ): অজুর পর লজ্জাস্থান সংলগ্ন কাপড়ে সামান্য পানি ছিটিয়ে দিন। এতে পরবর্তীতে আর্দ্রতা অনুভব হলে তা পানির কারণে হয়েছে বলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া সহজ হবে এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা দূর হবে।
৩. নামাজ চলমান রাখা: নামাজের মধ্যে সন্দেহ হলে তা উপেক্ষা করুন। যতক্ষণ নিশ্চিত প্রমাণ না পাচ্ছেন, নামাজ ভাঙবেন না।
৪. চিকিৎসা ও সতর্কতা: যদি সমস্যাটি নিয়মিত হয় এবং কাপড়ে নাপাকির দাগ দেখা যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং মাজুর হিসেবে অজু করে নামাজ আদায় করুন।
অতএব, অহেতুক সন্দেহ বা মনের ভুল ধারণা দিয়ে ইবাদতকে কঠিন করা ইসলামের শিক্ষা নয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী পানি ছিটানো এবং সহিহ হাদিসের ওপর আমল করে মনকে ধীরস্থির রাখাই মুমিনের কাজ। মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য দ্বীনকে সহজ করেছেন। সঠিক জ্ঞানের মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকাই কাম্য।