ধর্ম ডেস্ক
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৫ পিএম
ক্ষমতা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি মহান আমানত। এ আমানতের সঠিক ব্যবহার শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, আর এর অপব্যবহার উভয়কে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণ শাসকের গুণাবলি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা যুগে যুগে মানুষের জন্য পথনির্দেশক হয়ে আছে।
একজন আদর্শ শাসকের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহমুখিতা। হজরত সুলাইমান (আ.) বিপুল রাজত্ব ও ক্ষমতা লাভের পরও বলতেন, ‘নিশ্চয়ই এটি আমার রবের সুস্পষ্ট অনুগ্রহ’ (সুরা নামল: ১৬)। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই গুণের প্রশংসা করে বলেন, ‘সে ছিল উত্তম বান্দা; নিশ্চয়ই সে ছিল অতিশয় আল্লাহ-অভিমুখী।’ (সুরা সাদ: ৩০) ক্ষমতা যেন শাসককে অহংকারী না বানায়, বরং আল্লাহর নিকট বেশি বিনয়ী ও জবাবদিহিমুখী করে, এটিই কোরআনি শিক্ষা।
হজরত দাউদ (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করো এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’ (সুরা সাদ: ২৬) ন্যায়বিচার শাসনের প্রাণ। ধনী-দরিদ্র, শক্তিশালী-দুর্বল, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলের প্রতি সমান ন্যায়বিচার করা শাসকের অপরিহার্য দায়িত্ব।
আরও পড়ুন: কোরআনের বর্ণনায় মুনাফিকের ১৫ বৈশিষ্ট্য
হজরত মুসা (আ.) তাঁর ভাই হারুন (আ.)-কে দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি সবকিছু সংশোধন করবে এবং ফাসাদকারীদের অনুসরণ করবে না।’ (সুরা আরাফ: ১৪২) শাসকের দায়িত্ব সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সকল প্রকার অনাচার ও বিশৃঙ্খলা দূর করা।
জুলকারনাইনের ঘটনায় আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণ শাসনের একটি মৌলিক নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘যে সীমালঙ্ঘন করবে, আমরা তাকে শাস্তি দেব... আর যে ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান।’ (সুরা কাহাফ: ৮৭-৮৮) এটিই ন্যায়পরায়ণ শাসনের ভিত্তি: সৎলোকের পৃষ্ঠপোষকতা ও অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি।
জুলকারনাইন ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচার থেকে জনগণকে রক্ষা করতে প্রাচীর নির্মাণের প্রস্তাব পান। জনগণ বিনিময়ে অর্থ দিতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমার রব আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, সেটাই আমার জন্য শ্রেয়।’ (সুরা কাহাফ: ৯৫) প্রকৃত শাসক জনসেবাকে ইবাদত মনে করেন এবং আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতাকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেন।
আরও পড়ুন: যাকে নেতা মানলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন
প্রাচীর নির্মাণের সফলতা লাভের পর জুলকারনাইন বলেন, ‘এটি আমার রবের রহমত।’ (সুরা কাহফ: ৯৮) ক্ষমতার সাফল্যে অহংকার নয়, বরং বিনয় ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়; এটিই মুমিন শাসকের বৈশিষ্ট্য।
হজরত ইউসুফ (আ.) দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে বাদশাহকে বলেন, ‘আপনি আমাকে দেশের কোষাগারের দায়িত্ব দিন। আমি রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম ও জ্ঞানসম্পন্ন।’ (সুরা ইউসুফ: ৫৫) শাসক বা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও আমানতদারিতা থাকা আবশ্যক।
রাণী বিলকিসের পাঠানো মূল্যবান উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করে হজরত সুলাইমান (আ.) বলেন, ‘তোমরা কি ধন-সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া সম্পদের চেয়ে উত্তম।’ (সুরা নামল: ৩৬)। ন্যায়পরায়ণ শাসক কখনো ঘুষ, উপঢৌকন বা অন্যায় সুবিধার বিনিময়ে নিজের নীতিকে বিক্রি করেন না।
আরও পড়ুন: কেয়ামতে আপনার নেতার নামে ডাক পড়বে! জেনে নিন কীভাবে বাঁচবেন
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন, আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে।’ (সুরা নিসা: ৫৮) শাসনক্ষেত্রে আমানতদারি ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তির কর্তব্য।
সর্বোপরি, একজন মুমিন শাসকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা। আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন, ‘আপনি তাদের মধ্যে বিচার করুন সেই বিধান অনুসারে, যা আল্লাহ নাজিল করেছেন।’ (সুরা মায়েদা: ৪৮) এর বিপরীত পথকে কোরআন ‘জাহেলিয়াতের শাসন’ বলে ঘোষণা করেছে।
প্রিয় পাঠক, কোরআনের এসব শিক্ষা কেবল রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসকের জন্যই প্রযোজ্য নয়। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কখনো না কখনো নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করি। এসব ক্ষেত্রে কোরআনের এই নীতিমালা আমাদের পথ দেখাবে। ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারিতা, আল্লাহভীতি ও দায়িত্ববোধ—এসব গুণেই একজন ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে ন্যায়পরায়ণ নেতা বা শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।