ধর্ম ডেস্ক
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৩২ পিএম
রমজানের বার্তাবাহী পবিত্র মাস
ইসলামি বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস রজব আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে ভাস্বর এক আধ্যাত্মিক মৌসুম। দেশের আকাশে ১৪৪৭ হিজরির রজব মাসের চাঁদ দেখা দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এই সম্মানিত মাসের গণনা। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত চারটি সম্মানিত মাসের (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম রজব, যা মুমিনের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তাবাহী মাহে রমজানের প্রস্তুতিপর্ব ও আত্মগঠনের সূচনাকাল হিসেবে বিবেচিত।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি। তার মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ (সুরা তাওবা: ৩৬)
এই আয়াতের আলোকে স্পষ্ট হয়, রজব মাস আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষ সম্মান ও পবিত্রতার অধিকারী। এ মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: দেশের আকাশে দেখা গেছে রজবের চাঁদ
রাসুলুল্লাহ (স.) সম্মানিত মাসগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- ‘তিনটি মাস ধারাবাহিক- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম; আর অপরটি হলো রজব।’ (সহিহ বুখারি: ৩১৯৭; সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯) অন্য বর্ণনায় এসেছে- ‘রজব মাস জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ (সহিহ বুখারি: ৪৬২; সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯)
রজব মাসের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে একটি মহাস্মরণীয় ঘটনার কারণে। ওলামায়ে কেরামের মতে, প্রসিদ্ধ মতানুসারে ২৬ রজব দিবাগত রাতে সংঘটিত হয় মহানবী (স.)-এর ইসরা ও মিরাজ। এই রাতে তিনি সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে গমন করেন এবং উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো অতুলনীয় ফরজ ইবাদতের বিধান নিয়ে ফিরে আসেন।
রজব মাসের আগমনে রাসুলুল্লাহ (স.) রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং একটি বিশেষ দোয়া নিয়মিত পাঠ করতেন- اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শা‘বানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (সুনান নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬)
ইমাম মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন- ‘এই দোয়ার মাধ্যমে রজব ও শাবানে ইবাদতের তাওফিক এবং রমজানে পূর্ণমাত্রায় সিয়াম ও কিয়ামের সামর্থ্য প্রার্থনা করা হয়েছে।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ: ৩/৪৬৩)
আরও পড়ুন: রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া, হাদিসে যা আছে
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন- ‘রজব মাস এলে আমরা নবীজি (স.)-এর আমলের পরিবর্তন স্পষ্টভাবে বুঝতে পারতাম।’ তিনি রমজান ছাড়া সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন শাবান মাসে; পাশাপাশি রজব মাসেও তাঁর নফল ইবাদত ও আল্লাহমুখী আমল বৃদ্ধি পেত। এটি প্রমাণ করে যে রজব মাস আত্মপ্রস্তুতি ও আমল বৃদ্ধির সময়।
ইমাম আবু বকর আল-বালখি (রহ.) বলেন- ‘রজব হলো বীজ বপনের মাস, শাবান হলো সেই বীজে পানি সিঞ্চনের মাস, আর রমজান হলো ফসল তোলার মাস।’ (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২১৮)
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, যেন আত্মা ধীরে ধীরে রমজানের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে এবং আমল রমজানের ছন্দে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফিক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কোরআন, জাসসাস: ৩/১১১; মারেফুল কোরআন: ৪/৩৭২)
আরও পড়ুন: রজব মাসে গুনাহমুক্ত থাকার সুফল
রজব মাসকেন্দ্রিক নির্দিষ্ট কোনো নামাজ বা নির্ধারিত দিনের বিশেষ রোজার ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে হারাম মাস হওয়ায় এ মাসে নফল রোজা রাখা মোস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা বর্জনও করো।’ (সুনান আবু দাউদ: ২৪২৮)
রজব মাসে কিছু জায়গায় বিভিন্ন প্রথা ও রসম-রেওয়াজ পালন করা হয়, যা ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের ‘আতীরা’ প্রথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। জাহেলি যুগে মুশরিকরা স্বীয় প্রতিমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রজব মাসে পশু জবাই করত, যাকে ‘আতীরা’ বলা হত। রাসুলুল্লাহ (স.) এই শিরকি প্রথার উচ্ছেদ ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামে ‘ফারা’ (উট বা বকরির প্রথম বাচ্চা প্রতীমার উদ্দেশ্যে) জবাই করার কোনো প্রথা নেই এবং ‘আতীরা’ও নেই। অর্থাৎ রজব মাসে প্রতীমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করার প্রথাও নেই।’ (সহিহ বুখারি: ২/৮২২)
অনুরূপভাবে বর্তমান সময়েও কিছু স্থানে ইসলাম বহির্ভূত নানা আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন দেখা যায়, যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে মান্নত করা, বিশেষ নামে পশু জবাই, নির্দিষ্ট স্থানে লাল কাপড়ে মোড়ানো পাত্র স্থাপন, এবং নাচ-গানসহ বিভিন্ন অশ্লীলতা সংবলিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এসব কাজ শিরক ও বিদআতের অন্তর্ভুক্ত এবং কঠোরভাবে পরিহার করা উচিত।
রজব মাস আত্মশুদ্ধি, আমল বৃদ্ধি এবং রমজানের জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির এক সুবর্ণ সুযোগ। নবীজির সুন্নত অনুযায়ী আমল করে এবং সব ধরনের ভিত্তিহীন ও কুসংস্কারমূলক কার্যক্রম থেকে দূরে থেকে এই মাসকে রমজানের প্রস্তুতির সোপান বানানোই একজন মুমিনের কাম্য।
আসুন, আমরা এই পবিত্র মাসে নবীজির শেখানো দোয়া নিয়মিত পাঠ করি, আত্মশুদ্ধির সাধনায় মনোনিবেশ করি এবং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মাহে রমজানের অপেক্ষা করি।