ধর্ম ডেস্ক
১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম
ইসলামের ইতিহাসে হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) শুধু একজন শাসক ছিলেন না; তিনি ছিলেন ন্যায়, সত্য ও তাকওয়ার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি ও নৈতিক দৃঢ়তা বিরাজ করত, যা সহিহ হাদিসের ভাষ্যমতে শয়তানও পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে পালাত। এটি কোনো অতিরঞ্জন নয়; বরং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জবানেই বর্ণিত এক অকাট্য ও চিরসত্য ঘটনা। আসুন, সেই মহাপুরুষের অনন্য গুণাবলি ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো আরও গভীরে জানি।
হজরত ওমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণছিল দাওয়াতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। নবীজি (স.) স্বয়ং দোয়া করেছিলে- ‘হে আল্লাহ! ইসলামকে ওমর ইবনুল খাত্তাব বা আবু জাহলের মাধ্যমে শক্তিশালী করুন।’ (সিরাত ইবনে হিশাম)
এই দোয়ার বরকতে ওমর (রা.)-এর ইসলামগ্রহণ মুসলিম সমাজকে গোপনীয়তা থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। তাঁর নেতৃত্বে মুসলমানরা প্রথমবারের মতো দলবদ্ধভাবে কাবায় নামাজ আদায় করেন, যা ছিল তখনকার সময়ের জন্য এক সাহসী ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন- ‘যদি আমার পরে কোনো নবী আসতেন, তবে তিনি অবশ্যই ওমর ইবনুল খাত্তাব হতেন।’ (সুনান তিরমিজি: ৩৬৮৬)
এই বাণী ওমর (রা.)-এর নবুয়তসুলভ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতার স্বীকৃতি।
আরও পড়ুন: হজরত ওমরের পছন্দ অনুযায়ী কোরআন নাজিলের ৫ ঘটনা
মহান সাহাবির এই অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একাধিক সহিহ হাদিসে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন হজরত ওমর (রা.) নবীজির নিকট প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, তখন কিছু কোরাইশ মহিলা নবীজিকে প্রশ্ন করছিলেন, তখন তাদের কণ্ঠস্বর নবীজির চেয়েও চড়া ছিল। হজরত ওমর (রা.)-এর উপস্থিতি টের পেয়েই ওরা পর্দার আড়ালে চলে গেলো। ওমর (রা.) প্রবেশ করলে রাসুল (স.) হাসলেন এবং বললেন- ‘হে ইবনে খাত্তাব! সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! শয়তান যখন তোমার সম্মুখীন হয়, তখন সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে যায়।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৫৬)
বুরাইদা (রা.) বর্ণনা করেন, এক অভিযান থেকে ফিরে আসার পর এক মহিলা নবীজি (স.)-এর সামনে এসে তার মানত পূরণার্থে দাফ বাজানো শুরু করেন। হজরত আবু বকর (রা.), আলী (রা.) এবং উসমান (রা.) যথাক্রমে আসলেও তিনি বাজানো বন্ধ করেননি। কিন্তু হজরত ওমর (রা.) প্রবেশ করামাত্র সে দফটি তার নিতম্বের নীচে রেখে তার উপর বসে পড়ে। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- হে ওমর! তোমাকে দেখলে শয়তানও ভয় পায়।’ (সুনান তিরমিজি: ৩৬৯০)
আরও পড়ুন: মদিনা থেকে হজরত ওমরের নির্দেশ, ইরানে শুনেছেন সেনাপতি
১. সত্যের প্রতি অটল নিষ্ঠা: তিনি কখনো সত্য বলতে বা প্রতিষ্ঠা করতে ভয় পেতেন না। নবীজি (স.) বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ওমরের মুখে সত্যকে স্থাপন করেছেন। তিনি ন্যায়নিষ্ঠার সাথেই কথা বলেন। (সুনানে আবু দাউদ: ২৯৬২)
২. গভীর আল্লাহভীতি ও তাকওয়া: তিনি রাত্রি জাগরণে আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন এবং দিনে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতেন। তাঁর বিখ্যাত দোয়া- ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসিব করুন এবং আমার মৃত্যু আপনার রাসুলের শহরে দান করুন।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৯০)
৩. ইতিহাস সৃষ্টিকারী ন্যায়বিচার: হজরত ওমর (রা.)-এর ন্যায়বিচার ছিল শাসন ও বিচারব্যবস্থার এক জীবন্ত মহাকাব্য। তিনি সত্য ও ইনসাফকে এমন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর থেকে সাধারণ প্রজা সকলেই ছিল আইনের চোখে সমান। তাঁর এই ন্যায়ের অবিচল ভিত্তির কারণে প্রচলিত হয়েছে এক প্রবাদ- ‘ওমরের যুগে নেকড়ে ও মেষ একই জলাশয়ে পানি খেত।’ তাঁর ন্যায়বিচার জালেম ও শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে ছিল ইস্পাতকঠিন।
৪. গভীর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব: হজরত ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রনীতির এক অদ্বিতীয় স্থপতি ও কালজয়ী চিন্তাবিদ। তাঁর প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পাওয়া যায় এই সত্যে যে, বহু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অভিমত ও পরামর্শের সমর্থনে নাজিল হয়েছিল পবিত্র কোরআনের আয়াত, যা এক অনন্য ঐশী মর্যাদার সাক্ষ্য বহন করে। (তাফসির ইবনে কাসির; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
হজরত ওমর (রা.)-এর জীবন বর্তমান মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহান শিক্ষা। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি:
যে ব্যক্তি বা সমাজ এই গুণাবলি অর্জন করতে পারে, শয়তান তার জন্য কোনো হুমকি নয়। হজরত ওমর (রা.) তাই শুধু ইতিহাসের পাতায় নন, প্রতিটি ঈমানদার হৃদয়ের জন্য চিরন্তন পথপ্রদর্শক।