ইসলামের ইতিহাসে হজরত ওমর (রা.) এমন এক সাহাবি, যিনি ন্যায়পরায়ণতা, সৎ সাহস ও দ্বীনি গভীরতায় অনন্য ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) একাধিকবার বলেছেন- لَوْ كَانَ نَبِيٌّ بَعْدِي لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ ‘যদি আমার পর কোনো নবী আসত, তবে তা হতো ওমর বিন খাত্তাব।’ (তিরমিজি: ৩৬৮৬, মুসনাদে আহমদ: ১৭৪০৫, আলমুজামুল কাবির লিততাবারানি: ৮২২)
ওমর (রা.) প্রকৃত কোরআনপ্রেমী ছিলেন। তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তিন হক বুঝতে পারতেন এবং হকের কাছে মাথানত করতেও সদাপ্রস্তুত থাকতেন। কোরআনের আকর্ষণে, কোরআনের সতত্য অনুধাবন করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি।
বিজ্ঞাপন
আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন এক গুণ দিয়েছিলেন, যার বর্ণনা হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় উঠে এসেছে। এক হাদিসে নবীজি বলেন, আল্লাহ তাআলা ওমরের জবানে সত্য ঢেলে দেন, সে তাই বলে। (সুনানে আবু দাউদ: ২৯৬২)
মূলত কোরআনের প্রতি ওমরের (রা.) সীমাহীন ভালোবাসা ও ভক্তির বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরে এমন সব কথা ঢেলে দিতেন, যেটা স্বয়ং কোরআনের কথা; আল্লাহর মর্জি ও সন্তুষ্টির কথা। ফলে পরবর্তীতে সে বার্তা নিয়েই কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে। এখানে সেরকম পাঁচটি ঘটনা তুলে ধরা হলো।
১. বদরের বন্দীদের ব্যাপারে মতামত
ঘটনার বিবরণ: বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে অনেক কাফের বন্দি হয়। রাসুল (স.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমরা মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দিই।’ কিন্তু ওমর (রা.) বলেন, ‘তারা হলো কাফের নেতা। আমরা তাদের হত্যা করি, যেন ইসলাম শত্রুমুক্ত হয়।’ রাসুল (স.) আবু বকর (রা.)-এর পরামর্শ অনুযায়ী ফয়সালা করলেন। পরে ওমর (রা.)-এর মতামতকে সমর্থন করে কোরআনের আয়াত নাজিল হলো।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: মদিনা থেকে হজরত ওমরের নির্দেশ, ইরানে শুনেছেন সেনাপতি
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করলেন– নবীর জন্য উপযুক্ত নয় যে, তিনি বন্দি গ্রহণ করবেন, যতক্ষণ না যুদ্ধে শত্রুদের ভালোভাবে দমন করেন।’ (সুরা আনফাল: ৬৭) এই আয়াতে হজরত ওমরের (রা.) অবস্থানকে সমর্থন করে কঠিন শাস্তির পক্ষেই আল্লাহর আদেশ আসে।
২. হিজাব বা পর্দার বিধান
ঘটনার বিবরণ: ওমর (রা.) একাধিকবার রাসুল (স.)-কে বলেছিলেন, ‘আপনার ঘরে নানা ধরণের লোক আসে, আপনি যদি আপনার স্ত্রীদেরকে হিজাবের আড়ালে রাখতেন, তা শ্রেয় হতো।’ এর পরে আয়াত নাজিল হয়, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নবীর স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইতে যাও, তখন পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে।’ (সুরা আহজাব: ৫৩) এ আয়াতে নারীদের হিজাব বা পর্দার বিধান প্রবর্তিত হয়, যা ওমর (রা.)-এর প্রস্তাবনার প্রতিফলন।
৩. মদের হারাম হওয়ার প্রক্রিয়া
ঘটনার বিবরণ: মদ তখন আরব সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। হজরত ওমর (রা.) বারবার দোয়া করতেন- ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য মদের বিষয়ে একটি স্পষ্ট বিধান দিন।’ এরপর ধাপে ধাপে তিনটি আয়াত নাজিল হয়।
আরও পড়ুন: মদ খেলে কি ৪০ দিন শরীর নাপাক থাকে?
প্রথমে বলা হয়, ‘তারা জিজ্ঞেস করে, মদ ও জুয়ার বিষয়ে। বলুন- এতে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও রয়েছে, কিন্তু পাপ উপকার থেকে বড়।’ (সুরা বাকারা: ২১৯) এরপর বলা হয়, ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাজে অবস্থান করো, তখন মাতাল অবস্থায় থাকো না।’ (সুরা নিসা: ৪৩) সর্বশেষ আয়াত- ‘হে ঈমানদারগণ! নিঃসন্দেহে মদ, জুয়া, প্রতিমা, ভাগ্য নির্ধারণকারী তীর - এ সব শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, এসব থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো।’ (সুরা মায়েদা: ৯০) এই চূড়ান্ত আয়াতের মাধ্যমে মদ সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যায়, এবং হজরত ওমরের দোয়ার বাস্তবায়ন ঘটে।
৪. মুনাফিকদের জানাজা
ঘটনার বিবরণ: মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মৃত্যুবরণ করলে রাসুল (স.) তার জানাজা পড়াতে চাইলেন। ওমর (রা.) বাধা দেন এবং বলেন, ‘সে মুনাফিক, তার জানাজা পড়া উচিত নয়।’ এরপর রাসুল (স.) তার জানাজার নামাজ আদায় করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আয়াত নাজিল হয়- ‘আর তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাজা পড়বেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না; তারা তো আল্লাহ ও তার রাসুলকে অস্বীকার করেছিল এবং ফাসেক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। (সুরা তাওবা: ৮৪) পরে রাসুল (স.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর আদেশ পাইনি, তাই পড়েছি। এখন আমি আর মুনাফিকদের জানাজা পড়ব না।’
আরও পড়ুন: জানাজার নামাজের নিয়মকানুন, গুরুত্ব ও ফজিলত
৫. মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থান বানানো
ঘটনার বিবরণ: ওমর (রা.) প্রস্তাব দেন যে, মক্কায় কাবাঘরের পাশে অবস্থিত ‘মাকামে ইব্রাহিম’-এ নামাজ আদায় করা উচিত। এরপর আয়াত নাজিল হয়- ‘আর তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে নামাজের স্থান বানাও।’ (সুরা বাকারা: ১২৫) এই আয়াত হজরত ওমরের মতামত অনুযায়ী নাজিল হয়।
হজরত ওমর (রা.)-এর অন্তর্দৃষ্টি ও ইসলামের প্রতি গভীর দরদ ছিল এমন পর্যায়ে যে, তাঁর প্রস্তাবনাগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকেও সমর্থিত হয়। ঘটনাগুলো কেবল তাঁর ব্যক্তিত্বকেই নয়, বরং ইসলামি শরিয়তের বিকাশে সাহাবিদের অংশগ্রহণের গুরুত্বও তুলে ধরে।
এই ঘটনাগুলো আমাদের শেখায়, ঈমানদারদের চিন্তা ও প্রজ্ঞা কতখানি মূল্যবান হতে পারে যখন তা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হজরত ওমরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাঁর ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তির শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

