images

ইসলাম

মাগরিবের পর ঘুমালে কী হয়? সুন্নাহ ও বিজ্ঞানের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি

ধর্ম ডেস্ক

০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৫ পিএম

মাগরিবের পর ঘুমানো নিয়ে মুসলিম সমাজে নানা ধারণা প্রচলিত। কেউ এটিকে হারাম মনে করেন, কেউ বলেন রিজিক কমে যায়। কিন্তু বিচারের আসল মানদণ্ড তো আমাদের  ধারণা নয়, বরং কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা। নবীজি (স.) নিজে মাগরিবের পর ঘুমাতেন না এবং এশার পর দ্রুত ঘুমিয়ে রাতের একাংশ ইবাদতে কাটাতেন। এই প্রতিবেদনে সহিহ দলিল, ফিকহি ব্যাখ্যা ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হলো।

সুন্নাহর নির্দেশনা

আবু বারযা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) এশার আগে ঘুমানো এবং এশার পর কথোপকথনে মশগুল হওয়া অপছন্দ করতেন।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৮) আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি কখনো নবীজি (স.)-কে এশার আগে ঘুমাতে দেখিনি, আর এশার পর অহেতুক কথাবার্তায় মশগুল দেখিনি।’ (ইবনে মাজাহ: ৭০২) এই হাদিসগুলো নির্দেশ করে, মাগরিব থেকে এশার সময় ঘুম এড়িয়ে চলা সুন্নাহ।

শরয়ি ও হিকমতসম্মত কারণ

মাগরিবের পর ঘুমালে এশার নামাজ কাজা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এই সময় দোয়া, জিকির ও এশার জামাতের ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুনাফিকদের জন্য ফজর ও এশার নামাজের চেয়ে অধিক ভারী কোনো নামাজ নেই। এ দুই নামাজের ফজিলত যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা উপস্থিত হত।’ (বুখারি: ৬৫৭) অর্থাৎ সন্ধ্যার মুহূর্তটি ঘুমের সময় নয়; বরং এশার নামাজের প্রস্তুতির সময়। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও খাবারের পর ঘুম পরিপাক প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও সন্ধ্যায় গভীর ঘুমের ক্ষতি ও ক্লান্তি বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে।

ঘুমের মূল সময় হলো রাত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদের ঘুমকে করেছি বিশ্রাম বা ক্লান্তি দূরকারী, রাতকে করেছি আবরণ।’ (সুরা নাবা: ৯-১০)

আরও পড়ুন: ফজর-আছর-এশা নামাজের বিশেষত্ব

ফিকহি বিধান

আলেমগণ একমত যে মাগরিবের পর ঘুমানো হারাম নয়, তবে মাকরুহে তানজিহি। ইমাম নববি (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন, এটি অপছন্দনীয় কারণ এতে এশার নামাজের বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে অসুস্থ, ক্লান্ত বা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য নয়। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘কেননা এশার পূর্বে ঘুমালে মূল ওয়াক্তই চলে যেতে পারে অথবা উত্তম ওয়াক্ত ছুটে যেতে পারে।’ (ফাতহুল বারি: ৫৭৪)

ইবনুল কাইয়িম (রহ.)-এর বিশ্লেষণ

ইবনুল কাইয়িম তাঁর গ্রন্থ ‘জাদুল মাআদ’-এ নবীজির ঘুমের রুটিন বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। নবীজি (স.) এশার নামাজের পর দ্রুত ঘুমিয়ে রাতের প্রথমাংশে বিশ্রাম নিতেন এবং মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের জন্য জাগ্রত হতেন। এই রুটিন শরীরের প্রাকৃতিক ঘুম চক্র, হজম ক্ষমতা ও ইবাদতের ভারসাম্য রক্ষা করত।

আধুনিক বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য

সার্কেডিয়ান রিদম অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬–৮টার সময় গভীর ঘুমের জন্য উপযুক্ত নয়। এই সময় ঘুমালে রাতের গভীর ঘুম বিঘ্নিত হয়, সকালের সতেজতা কমে, মেটাবলিজম ধীর হয় এবং পরিপাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাবারের পর ঘুমানো গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি ও মানসিক বিষণ্ণতা তৈরি করতে পারে।

আরও পড়ুন: দোয়া পড়লে মস্তিষ্কে কী ঘটে? কোরআন ও আধুনিক সাইকোলজির অভাবনীয় সমন্বয়

ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান

যদি অতিরিক্ত ক্লান্তি থাকে, হালকা বিশ্রাম বা ২০ মিনিটের পাওয়ার ন্যাপ গ্রহণ করা যায়। এরপর এশার জন্য প্রস্তুতি নিন। কোরআন তেলাওয়াত, পরিবার ও ধর্মীয় আলোচনা বা হালকা শারীরিক কার্যক্রম সন্ধ্যার সময়কে পুণরুজ্জীবন এবং ইবাদতের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নবীজি (স.)-এর মতো হালকা বিশ্রাম গ্রহণ করা, কিন্তু গভীর ঘুমে না যাওয়াই সুন্নাহ।

বিশেষ পরিস্থিতি

অসুস্থ, গর্ভবতী, শিশু, বৃদ্ধ বা রাতের শিফটের কর্মীর জন্য সন্ধ্যায় ঘুম গ্রহণযোগ্য। ইমাম আহমাদ (রহ.) উল্লেখ করেছেন, প্রয়োজনের সময় মাকরুহ মাফ করা যায়। 

সংক্ষেপে বলতে গেলে, মাগরিবের পর ঘুমানো ‘নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ‘অপছন্দনীয়’। কেননা এটি নামাজ ও সুস্থ জীবনের সুন্নতি ছন্দকে ব্যাহত করে। তবে কুলক্ষণের কাজ বা দরিদ্রতার লক্ষণ- এমন কথা ভুল। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নবীজি (স.)-এর সেই ভারসাম্যময় রুটিনের অনুসরণ, যা দেহ, মন ও আত্মার সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করে।