images

ইসলাম

নির্জনে আল্লাহর জিকির: আত্মার পরিশুদ্ধি ও জীবনে বিস্ময়কর প্রতিফলন

ধর্ম ডেস্ক

০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:১২ পিএম

সর্বক্ষণ আল্লাহ তাআলার স্মরণে নিমগ্ন থাকা খাঁটি মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামে জিকির কেবল আনুষ্ঠানিক আমল নয়; এটি আত্মার খোরাক, মানসিক প্রশান্তির উৎস এবং নৈতিক জীবন গঠনের ভিত্তি। বিশেষভাবে নির্জনে আল্লাহর স্মরণ, যেখানে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে একান্তে কথা বলে, তার প্রভাব এতই গভীর যে এটি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক, মানসিক ও বাস্তব জীবনে বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটায়।

১. কোরআনের দিকনির্দেশনা: নিভৃতে রবের স্মরণ

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, সশংকচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়। আর উদাসীনদের অন্তভুক্ত হবেন না।’ (সুরা আরাফ: ২০৫)

এই আয়াত নির্দেশ করে, যে জিকির অন্তরের গভীর থেকে হতে হবে, নম্রভাবে, ভক্তি ও ভয়ের সঙ্গে, যাতে দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে।

আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’ (সুরা রাদ: ২৮)

নির্জনে এই শান্তি পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়, কারণ তখন হৃদয় সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ থাকে।

আরও পড়ুন: সারাদিন ৬ জিকিরের অবিশ্বাস্য ফজিলত

২. হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের নির্দেশনা

ক. মৃদু ও নিভৃতে জিকিরের আদব: এক সফরে সাহাবায়ে কেরাম উঁচু স্বরে তাকবির বলছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁদেরকে সম্বোধন করে বললেন- ‘হে লোকেরা! তোমরা নিজেদের জানের উপর দয়া করো। কারণ তোমরা কোনো বধির অথবা অনুপস্থিতকে আহবান করছ না বরং তোমরা আহবান জানাচ্ছ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টাকে।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩৮৪)

এই হাদিস নির্জনের জিকিরের অন্তরঙ্গ ও গোপন প্রকৃতি স্পষ্ট করে।

খ. আরশের ছায়ায় আশ্রয়: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘সাত শ্রেণির ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে… তাদের মধ্যে একজন হলো যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, ফলে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।’ (সহিহ বুখারি: ৬৬০)

নির্জনে আল্লাহর ভয়ে কান্নার এই আমল কেয়ামতের ভয়াবহতা থেকে সরাসরি আল্লাহর ছায়াতলে নিরাপত্তা প্রদান করে।

৩. নির্জনে জিকিরের শ্রেষ্ঠ রূপ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’

হাদিসে এসেছে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অতি উত্তম জিকির এবং আলহামদু লিল্লাহ অধিক উত্তম দোয়া’ (সুনান তিরমিজি: ৩৩৮৩)

ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) উল্লেখ করেন, ‘পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষীরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার মাধ্যমে অধিক জিকির করতেন। কারণ এটি শুধু জিহ্বার মাধ্যমে করা যায়, ঠোঁট নড়াচড়া ছাড়াই। ফলে বান্দা গোপনে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতে পারে।’ (ইলামুল মুওয়াক্কিঈন: ৩/২৮৭)

এটি দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে কার্যকর নির্জন জিকিরের অনন্য পদ্ধতি।

আরও পড়ুন: অন্তরে প্রশান্তির জন্য ছোট ছোট জিকির 

৪. নির্জনে জিকিরের প্রকৃত অর্থ: আনুগত্য ও ভয়ের সমন্বয়

প্রখ্যাত তাবেয়ি সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.) বলেন- ‘জিকির হলো আল্লাহর আনুগত্য। যে আল্লাহর আনুগত্য করল, সে তাঁর জিকির করল। আর যে আল্লাহর আনুগত্য করল না, সে তাঁর জিকির করল না; যদিও সে বেশি তাসবিহ পড়ে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে।’ (ইবনুল জাওজি, সিফাতুস সাফওয়া: ২/৪৫)

হাসান বসরি (রহ.) বলেন- ‘মুসলিম ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা দোয়া ও জিকিরে নিমগ্ন থাকে, কিন্তু কেউ তাঁদের আওয়াজ শুনতে পায় না; বরং দোয়া ও জিকিরের মৃদু শব্দ শুধু তাঁর রব ও তার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে।’ (তাফসির ইবনে কাসির: ৩/২৪৮)

নির্জনে জিকিরে অন্তরের ভয় ও আনুগত্য একত্রিত হয়ে আত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করে।

৫. নির্জনে জিকিরের উপকারিতা

আত্মিক পরিশুদ্ধি ও তাওবা: নিজের দুর্বলতা ও ভুল স্বীকার করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও মুহাসাবা সম্ভব।

গভীর মানসিক শান্তি: হৃদয় শান্ত ও মস্তিষ্কের চাপ কমে যায়।

আল্লাহর বিশেষ সাহায্য ও নৈকট্য: ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারা: ১৫২)

নৈতিক চরিত্র ও সামাজিক উন্নতি: ধৈর্য, দয়া, সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতা বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন: সৃষ্টিকূলে সর্বোচ্চ সওয়াব: ৩ জিকির প্রতিদিন ১০০ বার

৬. বাস্তব জীবনে নির্জনে জিকিরের কৌশল

নিয়মিত সময় নির্ধারণ: ফজরের পর ও রাতের শেষ তৃতীয়াংশে অন্তত ১৫-২০ মিনিট।

মৌন জিকির: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অন্তরে চলতে থাকবে।

প্রাকৃতিক নির্জনতা: বাগান, নদীর পাড় বা ফাঁকা স্থান ব্যবহার।

ডিজিটাল নির্জনতা: মোবাইল ও ইন্টারনেট থেকে দূরে সময় কাটানো।

নির্জনে আল্লাহর জিকির মানে হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত সুসম্পর্ক ও ভক্তি। কোরআন-সুন্নাহ এবং সলফে সালেহিনের জীবন প্রমাণ করে, যারা নিয়মিত নির্জনে আল্লাহর সঙ্গে সময় কাটায়, আল্লাহ তাদের শান্তি দেন, রক্ষা করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করেন। আধুনিক যুগের মানসিক অস্থিরতা ও নৈতিক সংকটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান হলো- নিয়মিত নির্জনে আল্লাহর জিকিরের অভ্যাস গড়ে তোলা।

‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখব।’ (সুরা বাকারা: ১৫২)