ধর্ম ডেস্ক
০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৫ পিএম
ইসলামে দোয়া একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। পাশাপাশি মানুষের মানসিক, আবেগিক ও স্নায়বিক স্থিতির জন্যও প্রাকৃতিক থেরাপি। কোরআন দোয়াকে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক তৈরির পথ হিসেবে পরিচয় করিয়েছে। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানও দেখিয়েছে-প্রার্থনা মস্তিষ্কে বাস্তব রাসায়নিক ও স্নায়বিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে, যা শান্তি, স্থিরতা ও স্ট্রেস কমাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে।
ইসলাম দোয়াকে মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কের প্রশান্তির উৎস হিসেবে উপস্থাপন করে। কোরআন ঘোষণা করে, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির: ৬০) এবং স্পষ্ট করে দেয়, ‘আল্লাহর জিকিরেই হৃদয় প্রশান্ত হয়। (আর-রাদ: ২৮) আবার কোরআনকে ‘শেফা ও রহমত’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। (ইসরা: ৮২)
হাদিসেও দোয়া ইবাদতের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) দোয়াকে ‘ইবাদতের মূল’ এবং ‘মুমিনের হাতিয়ার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইসলামি স্কলারদের মতে, দোয়ার মাধ্যমে যে প্রশান্তি অনুভূত হয় তা কেবল আধ্যাত্মিক আবহ নয়; বরং মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া বাস্তব বায়োকেমিক্যাল পরিবর্তনেরই প্রতিফলন।
আরও পড়ুন: দোয়ার অপার শক্তি, বান্দার প্রতিটি ডাকে আল্লাহর সাড়া
আধুনিক নিউরোসায়েন্সে দেখা যায়, দোয়া ও আধ্যাত্মিক প্রার্থনা মানুষের মস্তিষ্কে বহু স্তরে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
গবেষণা বলছে, নিয়মিত প্রার্থনা স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। এতে উদ্বেগ প্রশমিত হয়, শারীরিক উত্তেজনা হ্রাস পায় এবং মন স্থির থাকে। নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. অ্যান্ড্রু নিউবার্গের গবেষণায় দেখা যায়- গভীর ধর্মীয় প্রার্থনা সেরোটোনিন ও ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়ায়, যা আনন্দ ও প্রশান্তির অনুভূতি জাগায়।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে করা গবেষণায় দেখা গেছে, দোয়া ও ধ্যান মস্তিষ্কের অ্যামিগডালার অতিসক্রিয়তা কমায়। এটি ভয়, আতঙ্ক ও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, চিন্তায় ইতিবাচকতা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। এভাবে দোয়া ধীরে ধীরে মস্তিষ্ককে আরও স্থির, শান্ত ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞান দোয়াকে একধরনের কার্যকর মানসিক থেরাপি হিসেবে বিবেচনা করে। ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামির ড. মাইকেল ম্যাককালো ব্যাখ্যা করেন- প্রার্থনা মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মানসিক সহনশীলতা বাড়ায়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. লিসা মিলার গবেষণায় দেখিয়েছেন, স্থায়ী আধ্যাত্মিক সংযোগ হতাশার ঝুঁকি কমাতে এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করতে সহায়ক।
মনোবিশ্লেষকরা বলেন, দোয়া মানসিকভাবে তিনটি বড় উপকার দেয়- মানুষ তার মনের কথাগুলো প্রকাশ করে চাপ কমায়, আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিরাপত্তার অনুভূতি পায় এবং দোয়া কবুল হওয়ার আশায় ইতিবাচক প্রত্যাশা তৈরি হয়। এই তিনটি দিকই আধুনিক কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির (CBT) মূলনীতির সঙ্গে অসাধারণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন: প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৪০ দোয়া
দোয়াকে দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। দিনের শুরুতে সুরা ফাতিহা বা আয়াতুল কুরসি তেলাওয়াত মনোযোগ বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের শান্ত অবস্থা তৈরি করে। দুপুরে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পাঠ মানসিক চাপ হ্রাসে সহায়ক। রাতে সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করলে মন শান্ত হয় এবং ঘুমের মান উন্নত হয়। সাপ্তাহিকভাবে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে উপকারী বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
দোয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্কের ওপর যে প্রশান্তি আনে, কোরআন তা বহু আগে ঘোষণা করেছে। আজ আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান গভীর গবেষণার মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যাখ্যা করছে। প্রার্থনা মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্য তৈরি করে, মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বাণী- ‘দোয়া মুমিনের হাতিয়ার’ এখন শুধু ধর্মীয় কথন নয়; বরং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। দৈনন্দিন জীবনে দোয়া অন্তর্ভুক্ত করা তাই আধুনিক যুগের একজন মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে উপকারী এক জীবনবিধি।
এই সমন্বয় প্রমাণ করে, ইসলাম যে বিধান দিয়েছে তা কেবল পরকালীন মুক্তির পথই নয়, বরং ইহকালীন মানসিক সুস্থতা ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যরক্ষারও এক বিজ্ঞানসম্মত গাইডলাইন।
সূত্র:
Newberg & Waldman, How God Changes Your Brain
Lisa Miller, The Spiritual Child
Harvard Medical School– Neuroscience of Meditation
Koenig, Religion and Mental Health
Journal of Religion & Health