ধর্ম ডেস্ক
০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম
ইসলামের অটল ভিত্তি হলো তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত বিশুদ্ধ আকিদা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না...।’ (সুরা ইসরা: ২৩) কিন্তু বর্তমান মুসলিম সমাজে কিছু প্রচলিত রীতি ও বিশ্বাস, যেগুলোকে আমরা প্রায়শই ‘ভালোবাসা’ বা ‘সম্মান’ বলে আখ্যা দিই, সেগুলোই ধীরে ধীরে এই আকিদার বিশুদ্ধতাকে ক্ষয় করে। নির্দিষ্ট স্থান, বস্তু কিংবা ব্যক্তিকে শরিয়তের সীমা ছাড়িয়ে যে অতিমাত্রায় শ্রদ্ধা ও পবিত্রতার আসন দান করা হয়, তা সরাসরি বিদআতের পর্যায়ভুক্ত এবং শিরকের দিকে নিয়ে যাওয়ার এক বিপজ্জনক যাত্রা।
ইসলাম কবর জেয়ারতকে বৈধ করেছে, তবে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখার মধ্যে। এর উদ্দেশ্য হলো মৃত্যুকে স্মরণ করা, আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এবং মৃত মুমিনের জন্য দোয়া ও মাগফেরাত কামনা করা। কিন্তু যখন কবর বা মাজারকে ‘হাজত রওয়া’ বা সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়, যখন সেখানে গিয়ে মানত করা হয়, সাহায্য প্রার্থনা করা হয় কিংবা বিশেষ কোনো ফজিলতের আশায় নামাজ পড়া হয়, বাতি জ্বালানো হয়; তখন এটি ইসলামের সীমাকে লঙ্ঘন করে। রাসুলুল্লাহ (স.) এ বিষয়ে স্পষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন- ‘ইহুদি ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।’ (সহিহ বুখারি: ৪৩৫) ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর নবী (স.) অভিশম্পাত করেছেন (বেপর্দা) কবর জিয়ারতকারী মহিলাদের উপর এবং সেসব লোকদের উপর যারা কবরকে মসজিদ বানায় (কবরকে সেজদা করে) এবং সেখানে বাতি প্রজ্জ্বলিত করে। (তিরমিজি: ২/১৩৬)
আরও পড়ুন: বিদআতের বিরুদ্ধে সাহাবিদের কঠোর অবস্থান
আরেক হাদিসে তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থান বানিও না এবং আমার কবরকে ঈদের ময়দান বানিও না।’ (সুনান আবু দাউদ: ২০৪২) এখানে ‘ঈদের ময়দান’ বলতে বোঝানো হয়েছে এমন স্থানে পরিণত করা, যেখানে লোকেরা ঘন ঘন জমায়েত হয় এবং যার প্রতি অতিরিক্ত ধর্মীয় গুরুত্ব আরোপ করে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনী থেকেও এই সীমা রক্ষার চিত্র সুস্পষ্ট। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজির একটি চুল সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও সাহাবিগণ তাকে কখনোই অলৌকিক শক্তির বাহক মনে করেননি।
ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে পাথর, গাছ, মূর্তি ও নানা জড় বস্তুতে বরকত ও অলৌকিক শক্তির বিশ্বাস ছিল। তারা বিভিন্ন গাছের ডালে অস্ত্র ঝুলিয়ে ‘বরকত’ নিত, নির্দিষ্ট পাথরের সামনে বলি দিত। এগুলোই ছিল জাহেলি ধর্মীয় সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য। ইসলাম তাওহিদের আলো নিয়ে এসে এসব কুসংস্কার সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজও বহু মুসলিমের মাঝে সেই জাহেলি বিশ্বাসের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কোনো তাবিজ, মাজারির চাদর, অলির ব্যবহৃত পোশাক, নির্দিষ্ট পাথর, গাছের ডাল কিংবা কোনো স্থানে ঘষা দেওয়া- এসবের মাধ্যমে বরকত, রিজিক বা সমস্যা সমাধান আশা করা স্পষ্টভাবে তাওহিদের পরিপন্থী।
আবু ওয়াকিদ আল-লাইসি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, হুনাইনের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (স.) মুশরিকদের একটি গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই গাছটিকে ‘যাতু আনওয়াত’ বলা হতো। তারা এর মধ্যে তাদের অস্ত্রসমূহ লটকিয়ে রাখত। সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (স.)! যাতু আনওয়াতের মতো আমাদের জন্য একটা গাছের ব্যবস্থা করুন। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- সুবহানাল্লাহ! এটা তো মুসা (আ.)-এর উন্মাতের কথার মতো হলো। তারা বলেছিল, কাফিরদের যেমন অনেক উপাস্য রয়েছে তদ্রুপ আমাদেরও উপাস্যের ব্যবস্থা করে দিন।’ (তিরমিজি:২১৮০) এই হাদিস প্রমাণ করে- শরিয়ত অনুমোদন ছাড়া কোনো জড় বস্তুতে আধ্যাত্মিক শক্তি, বরকত বা অলৌকিক ক্ষমতা আরোপ করা জাহেলিয়াতেরই পুনরুজ্জীবন।
আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তোমরা আল্লাহকে ছাড়া যাদের ডাকে, তারা তোমাদের কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না।’ (সুরা ইউনুস: ১০৬) আরও উল্লেখ করেন- ‘আল্লাহ ছাড়া তারা এমন কিছুর ইবাদত করে, যা তাদের কোনো ক্ষতি বা লাভের মালিক নয়।’ (সুরা ফুরকান: ৫৫)
অর্থাৎ কোনো পাথর, গাছ, কাপড়, চাদর বা স্থানে বরকত আরোপ করা তাওহিদের স্পষ্ট পরিপন্থী।
আরও পড়ুন: দাফনের পর কবরে দাঁড়িয়ে তালকিন করা সুন্নত নাকি বিদআত?
ওলি-আউলিয়া, আলেম-মাশায়েখ ও নেককার ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রাখা ঈমানের দাবি। কিন্তু যখন এই ভালোবাসার মাত্রা শরিয়তের সীমানা পেরিয়ে যায়, যখন তাদেরকে ‘গায়েব জানেন’ বলা হয়, তাদের নামে শপথ করা হয়, তাদের কাছে সরাসরি হাজত বা সমস্যা দূরীকরণ প্রার্থনা করা হয়; তখন তা ইবাদতের রূপ ধারণ করে। অথচ ইবাদত চূড়ান্ত অর্থে একমাত্র আল্লাহরই হক। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আর তোমার রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব...’ (সুরা গাফির: ৬০) সাহায্য প্রার্থনার এই আহ্বান শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। রাসুল (স.) আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করল, সে শিরক করল।’ (সুনান আবু দাউদ: ৩২৫১) এখানেই ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁর ইবাদতের মাঝে পার্থক্যের রেখাটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট।
এই সকল বিচ্যুতি থেকে আকিদাকে রক্ষা করার একমাত্র পথ হলো কোরআন ও সহিহ সুন্নাহভিত্তিক জ্ঞানার্জন। প্রতিটি বিশ্বাস ও আমলকে ‘দলিল কোথায়?’ এই প্রশ্নের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে। কবর জেয়ারতকে তার প্রকৃত লক্ষ্য—মৃত্যু স্মরণ ও দোয়তে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বুজুর্গদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা হলো তাদের সুন্নাহ ও আদর্শের অনুসরণ করা, না যে তারা আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত, এরুপ বিশ্বাস পোষণ করা। সর্বোপরি, সকল প্রকার অন্ধ প্রচলন ও আবেগতাড়িত রীতিনীতিকে বর্জন করে রাসুলুল্লাহ (স.) ও তাঁর সাহাবিদের প্রদর্শিত সরল, স্পষ্ট পথকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ‘তোমরা বিদআত থেকে সতর্ক থাকো। কেননা প্রতিটি বিদআতই গুমরাহি।’ (সুনান আবু দাউদ: ৪৬০৭)
আরও পড়ুন: সাবধান! এই কাজ করলে হাউজে কাউসারের পানি থেকে বঞ্চিত হবেন
নির্দিষ্ট স্থান, বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি ‘অতিশ্রদ্ধা’ নামক এই সামাজিক ব্যাধি আকিদার মৌলিক কাঠামোকেই দুর্বল করে দেয়। এটি ঈমানের বিশুদ্ধতাকে নষ্ট করে এবং শির্কের দিকে ধাবিত হওয়ার একটি সূক্ষ্ম পথ তৈরি করে। ইসলামের আহ্বান হলো সরলতার দিকে- এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহর অনুসরণ। আমাদের উচিত নিজের বিশ্বাস ও আমলের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং যেকোনো ‘অতিরিক্ত’ বিষয় থেকে নিজের ঈমানকে হিফাজত করা। কোরআন ও সুন্নাহর সেই আলোকিত, শিরক বিদআতমুক্ত পথই হলো দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত সফলতার একমাত্র নিশ্চয়তা।