ধর্ম ডেস্ক
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২০ পিএম
মহানবী (স.)-এর মদিনায় হিজরতের পর মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন প্রতিষ্ঠা। এটি কেবল একটি নামমাত্র বন্ধন ছিল না, বরং পারস্পরিক ত্যাগ ও ভালোবাসার এক জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে মদিনায় নতুন ইসলামি সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। এই ভ্রাতৃত্ব সামাজিক সংহতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, যা ছিল এক নতুন রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি।
ইসলামে ভ্রাতৃত্বের ধারণা কোরআন ও হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সুরা হুজরাত: ১০)। আরেকটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন নর ও নারী একে অপরের বন্ধু’ (সুরা তাওবা: ৭১)। নবীজি (স.) মুমিনদের সম্পর্ককে দেহের উপমার মাধ্যমে বর্ণনা করে বলেন, ‘মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়; যখন একটি অঙ্গ ব্যথিত হয়, পুরো দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)। এই ঐশী ও নবুয়তি নির্দেশনা আনসার ও মুহাজিরদের আত্মত্যাগের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
আরও পড়ুন: সাহাবিদের ৫ ব্যতিক্রমধর্মী আমল: যুগে যুগে অনুপ্রেরণা
মদিনার আনসার সাহাবিগণ মুহাজির ভাইদের জন্য যে আত্মত্যাগ ও উদারতা দেখিয়েছিলেন, মানব ইতিহাসে তার তুলনা নেই। তারা নিজেদের সম্পদ, বাড়িঘর, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের সুখ পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। সাদ বিন রবি (রা.) মুহাজির ভাই আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘আমার অর্ধেক সম্পদ আপনার, আর আমার দুই স্ত্রীর মধ্যে যাকে পছন্দ করেন, তাকে আমি তালাক দেব’ (সহিহ বুখারি)। এই প্রস্তাব আনসারদের আত্মত্যাগ ও মহানুভবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আনসারদের এই মহানুভবতা সত্ত্বেও মুহাজির সাহাবিগণ নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ও স্বাবলম্বিতার অনন্য পরিচয় দেন। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) আনসারি ভাইয়ের প্রস্তাব গ্রহণ না করে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার সম্পদে বরকত দান করুন। আমাকে শুধু বাজার পর্যন্ত পথ দেখিয়ে দিন’ (সহিহ বুখারি)। অর্থাৎ তিনি নিজ শ্রমে ব্যবসা শুরু করতে চান। তিনি তাই করেছিলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছিলেন। এটি মুসলিম সমাজে শ্রমের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা স্থাপন করে।
আরও পড়ুন: সত্যের পথে ফিরে আসা মুমিনের অমূল্য গুণ
আনসারগণ শুধু নিজেদের সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েই থেমে থাকেননি; তারা মুহাজির ভাইদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্ভাবনী মডেলও তৈরি করেন। তারা প্রস্তাব করেছিলেন, ‘আমাদের খেজুরবাগান মুহাজির ও আমাদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করুন’। নবীজি (স.) এই প্রস্তাব গ্রহণ না করলে তারা একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন- ‘আপনারা শুধু কাজ করুন, আমরা ফসলের অর্ধেক দেব’। এই মডেলটি ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার এক আদর্শ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আনসার-মুহাজিরদের এই ভ্রাতৃত্ববন্ধন ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি ছিল একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রয়োগ এবং আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্বের চিরন্তন উদাহরণ। আল্লাহ তাআলা আনসারদের এই ত্যাগের বিশেষ প্রশংসা করে ইরশাদ করেন- ‘তারা নিজেদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়, যদিও নিজেদেরও প্রয়োজন ছিল।’ (সুরা হাশর: ৯)
আরও পড়ুন: আবু বকর (রা.)-এর দান সম্পর্কে চমৎকার এক হাদিস
আনসার-মুহাজিরদের এই ঐতিহাসিক মডেল বর্তমান সময়েও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। এটি আমাদের সম্পদে অন্যের অধিকার রক্ষা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি আত্মত্যাগ ও পারস্পরিক সাহায্যের মানসিকতা গড়ে তোলার প্রেরণা যোগায়। এই ভ্রাতৃত্বের আদর্শ আজও মানব সমাজে সম্প্রীতি ও ত্যাগের এক চিরন্তন উদাহরণ হয়ে আছে।