ধর্ম ডেস্ক
১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৩ পিএম
মসজিদ কেবল নামাজের স্থান নয়, বরং ইসলামি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগ থেকেই মসজিদকে দ্বীনী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফিকাহবিদদের মতামত নিচে তুলে ধরা হলো।
নববি যুগ: মসজিদে সুফফা ছিল ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র। রাফে বিন মালেক আনসারি (রা.) এ মসজিদের ইমাম ও মুয়াল্লিম (শিক্ষক) ছিলেন। (মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত, পৃষ্ঠা ৪৫১)
খুলাফায়ে রাশেদিন: হজরত ওমর (রা.) মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারিত করেন (তারিখুল ইসলাম, জাহাবি: ২/৪৩২)
ইমাম কাসানি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদের আয় থেকে দ্বীনি শিক্ষার খরচ করা যায়।’ (বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৩৩০)
ইবনে আবিদিন (রহ.) শর্তারোপ করে বলেন, ‘শিক্ষা কার্যক্রম মসজিদের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে।’ (রদ্দুল মুহতার: ৮/৩৬৭)
ইমাম নববি (রহ.) উল্লেখ করেন, ‘মসজিদে কোরআন শিক্ষা সর্বোত্তম আমল।’ (শরহু মুসলিম: ৫/৫৫)
আরও পড়ুন: মসজিদ ফান্ডের উদ্বৃত্ত টাকা সামাজিক কাজে ব্যয় করা যাবে?
মসজিদের আয় থেকে দ্বীনি শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
১. সাধারণ দান
মসজিদে সাধারণভাবে যে দান সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে দ্বীনি শিক্ষার খরচ করা যাবে। এক্ষেত্রে দাতা যদি নির্দিষ্ট কোনো শর্ত না দিয়ে থাকেন, তাহলে এই ফান্ড থেকে বয়স্ক শিক্ষা, কোরআন কারিম শেখানো, ইসলামিক বই বিতরণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় করা জায়েজ। তবে দাতা যদি বিশেষ কোনো খাত উল্লেখ করে দান করে থাকেন (যেমন: মসজিদ নির্মাণ বা ইমামের বেতন), তাহলে সেই টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা যাবে না।
২. মসজিদ মার্কেট/ভাড়া ইত্যাদির আয়
অনেক মসজিদের নিজস্ব মার্কেট বা ভাড়া দেওয়া সম্পত্তি থাকে, যার আয় মসজিদের বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয়। এই আয় থেকে দ্বীনি তালিমের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা সম্পূর্ণ বৈধ, কারণ এটি মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বীনি শিক্ষা মসজিদের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে ওয়াকফনামা বা স্থানীয় কমিটির নিয়ম-কানুন পর্যালোচনা করে নেওয়া উচিত, যাতে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে।
৩. জাকাতের ফান্ড
হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, মসজিদের সাধারণ ফান্ডে জাকাতের টাকা আলাদা রাখা উচিত এবং তা দ্বীনি শিক্ষার জন্য ব্যয় করা যাবে না। কারণ জাকাত শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ৮ শ্রেণির লোকদের মধ্যে বণ্টন করা যায় (সুরা তাওবা: ৬০)। তবে যদি কোনো দরিদ্র শিক্ষার্থী সরাসরি সাহায্য পায় (যেমন: তার বই-পত্র বা কোর্স ফি দেওয়া), তাহলে সেটা জাকাতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন: মসজিদের গাছের ফল ইমাম-মুয়াজ্জিন খেতে পারবে?
৪. সরকারি বা সংস্থার অনুদান
বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য অনুদান দেওয়া হয়। এই অর্থ দ্বীনি শিক্ষায় ব্যবহার করা যাবে, তবে অনুদানদাতা প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলী মেনে চলতে হবে। যেমন: কিছু প্রকল্পে শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের শিক্ষার জন্য টাকা বরাদ্দ থাকে, সেক্ষেত্রে বয়স্ক শিক্ষার জন্য তা ব্যবহার করা যাবে না।
৫. বিশেষ দাতাদের অর্থ
কেউ যদি সরাসরি ‘দ্বীনি শিক্ষার জন্য’ দান করে, তাহলে সেই টাকা শুধুমাত্র এই খাতেই ব্যয় করতে হবে। এ ধরনের দানকে ‘উদ্দেশ্যমূলক দান’ বলা হয় এবং এটি অন্যকোনো কাজে খরচ করা নৈতিক ও শরয়িভাবে অনুচিত।
৬. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
মসজিদের অর্থের ব্যবহারে স্বচ্ছতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
আরও পড়ুন: মসজিদের আদব: আল্লাহর ঘরে নিষিদ্ধ ১১ কাজ
এই নিয়মগুলো মেনে চললে মসজিদের ফান্ড থেকে দ্বীনি শিক্ষার ব্যয় সম্পূর্ণ শরিয়তসম্মত ও জবাবদিহিতামূলক হবে।
মসজিদের আয় থেকে দ্বীনি শিক্ষার ব্যয় সম্পূর্ণ শরয়ি সমর্থিত। বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৬২% মসজিদ ইতিমধ্যেই এ ধরনের কার্যক্রম চালু করেছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে স্থানীয় ওলামা ও কমিটির সমন্বয়ে একটি টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
তথ্যসূত্র: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ রিপোর্ট ২০২৩; ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪৫; আলবাহরুর রায়েক: ২/৩৪; বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৩৩০; বাংলাদেশ ফতোয়া বোর্ডের ২০২২ সালের নির্দেশিকা