images

ইসলাম

সৃষ্টিজগতের রহস্য অনুধাবনে কোরআনের আহ্বান

ধর্ম ডেস্ক

১৭ জুলাই ২০২৫, ০৩:২৫ পিএম

ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের চিন্তা-গবেষণাকে উৎসাহ দেয়। মানুষ যেন প্রকৃতি, মহাকাশ, মানবদেহ এবং জীবজগৎ নিয়ে চিন্তা করে—এ নির্দেশনা এসেছে কোরআন ও হাদিসে বহুবার। রাসুলুল্লাহ (স.) নিজেও আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন এবং সাহাবিদের তাতে উৎসাহিত করতেন, যাতে ঈমান দৃঢ় হয় এবং স্রষ্টাকে চিনতে পারে।

কোরআনের নির্দেশনা: সৃষ্টিজগৎ নিয়ে ভাবনা

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের আবর্তনে, নদী-সমুদ্রে চলমান জাহাজে, বৃষ্টির পানিতে—যা দিয়ে মৃত ভূমিকে সজীব করে এবং সব প্রাণীর বিস্তারে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং মেঘমালায়...এসবের মধ্যে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা বাকারা: ১৬৪)

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং দিন-রাতের পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করে এবং বলে—হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব কিছু অযথা সৃষ্টি করোনি।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৯১)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন, তাতে পাহাড় ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে প্রত্যেক প্রকার ফল জোড়ায়-জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাতের চাদরে আবৃত করেন। নিশ্চয়ই এসব বিষয়ের মধ্যে সেই সব লোকের জন্য নিদর্শন আছে, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।’ (সুরা রাদ: ৩)

এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে, প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা শুধু বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ নয়, বরং তা ইবাদতের পর্যায়ে পৌঁছায়।

আরও পড়ুন: আল্লাহর ৮টি অসীম কুদরত 

নবীজি (স.)-এর উৎসাহ ও সতর্কতা

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর নিয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা কর, তবে আল্লাহ তাআলার সত্তাকে নিয়ে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করো না।’ (তাবারানি: ৬৩১৯)

কারণ, মানুষ যদি আল্লাহ তালাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে মানুষ এর কূলকিনারা খুঁজে পাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা মানুষের চিন্তা-ভাবনা থেকে বহু গুণে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর (আল্লাহর) মতো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা এবং তিনি সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা আশ-শুরা: ১১) 

এখানে দুইটি স্পষ্ট বার্তা রয়েছে: ১. সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা করো—এতে ঈমান বাড়বে। ২. আল্লাহর সত্তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে বিরত থাকো—এতে বিভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে।

কোন কোন বিষয়ে চিন্তা করতে বলা হয়েছে?

১️. মানবদেহের জটিলতা: আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি… অতঃপর তাকে সুঠাম করেছি এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছি।’ (সুরা সাজদা: ৭-৯) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব, মানুষের দেখা উচিত কী বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষপাজরের মধ্য থেকে।’ (সুরা তারিক: ৫-৭)

২️. প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব: ‘তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কিভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? আকাশের দিকে কিভাবে তা উত্তোলিত হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়াহ: ১৭-২০)

৩️. প্রাণীকুল ও উদ্ভিদজগৎ: ‘ভূমিতে বিচরণশীল সব প্রাণী এবং ডানাওয়ালা পাখিগুলোও তোমাদের মতোই সম্প্রদায়।’ (সুরা আনআম: ৩৮)

এই আয়াতগুলো মানুষকে গভীরভাবে সবকিছুর উদ্দেশ্য ও নিখুঁত গঠনের দিকে মনোনিবেশ করতে বলে।

আরও পড়ুন: রহস্যময় সৃষ্টি আকাশ, জ্ঞানীদের চিন্তার খোরাক 

চিন্তা-গবেষণার ফায়দা

ঈমান বৃদ্ধি: আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন উপলব্ধি করে মানুষের ঈমান মজবুত হয়।

বিজ্ঞানচর্চার অনুপ্রেরণা: ইসলামের স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানীরা যেমন ইবনে সিনা, আল-খাওয়ারিজমি প্রমুখ, কোরআন ও হাদিস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গবেষণায় মনোযোগী হন।

অহংকার দূরীকরণ: সৃষ্টির বিশালতা ও জটিলতা মানুষকে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে, ফলে বিনয় আসে।

আল্লাহর সৃষ্টি গবেষণা যাদের কাজে আসে না

আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) তাদের বলুন, লক্ষ করে দেখ, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে কী কী জিনিস আছে? কিন্তু যেসব লোক ঈমান আনার নয়, (আসমান ও জমিনে বিরাজমান) নিদর্শনাবলী ও সতর্ককারী (নবী) তাদের কোনো কাজে আসে না।’ (সুরা : ইউনুস: ১০১)

তাদের প্রতি তিরস্কার ও নিন্দা। আল্লাহ তাআলার ভাষায়- ‘তারা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না, নাকি অন্তরে লেগে আছে তার (সংশ্লিষ্ট) তালা? (সুরা মুহাম্মদ: ২৪)

সতর্কতা

সত্তা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা: ‘আল্লাহকে কে সৃষ্টি করলেন?’—এ জাতীয় প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

শরিয়াবিরোধী মতবাদ এড়িয়ে চলা: নাস্তিক্যবাদ, ডারউইনিজম ইত্যাদি মতাদর্শে ভেসে যাওয়া চিন্তাশীল মুসলিমের জন্য মারাত্মক বিপদ।

চিন্তাশীলতা এক ইবাদত

আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা শুধু মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম নয়, বরং এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি মানুষকে ঈমানদার, গবেষণাপ্রবণ এবং আল্লাহভীরু করে তোলে। নবীজি (স.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকৃতি, মানবজীবন ও মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা করে আমরা যেমন ইহকালে উন্নত হতে পারি, তেমনি আখেরাতেও সফলতার আশা করতে পারি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার এবং সেসব চিন্তার আলোকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।