ধর্ম ডেস্ক
০৪ জুলাই ২০২৫, ০৫:২৫ পিএম
জিকির ও দোয়া হলো মুমিনের আত্মিক শক্তির উৎস। তা একদিকে যেমন অন্তরকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে, অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে এনে দেয় প্রশান্তি ও নিরাপত্তা। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে আর যে স্মরণ করে না, তাদের উদাহরণ জীবিত ও মৃতের মতো।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪০৭)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন- ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।’ (সুরা বাকারা: ১৫২)
এই প্রতিবেদনে আমরা কোরআন ও সহিহ হাদিসভিত্তিকভাবে জিকির ও দোয়ার সঠিক সময়, পদ্ধতি ও উপকারিতা আলোচনা করব—যাতে প্রতিটি মুসলিম এগুলোকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অভ্যাসে পরিণত করতে পারেন।
সকাল-সন্ধ্যার জিকির: প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় জিকির করা নবীজির সুন্নাহ এবং আত্মিক প্রশান্তির উৎস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকাল-সন্ধ্যায় তোমার রবের প্রশংসা পাঠ করো।’ (সুরা আলে ইমরান: ৪১)
নামাজ-পরবর্তী জিকির: নামাজের পর আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবিহ পাঠ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি প্রতি নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৩ বার আল্লাহু আকবার বলবে... তার গুনাহ ক্ষমা করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৯৭) এছাড়াও নামাজের পরের মাসনুন জিকিরগুলো করুন।
মসজিদ: মসজিদে জিকির করলে ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন ও রহমত বর্ষিত হয়। হাদিসের ভাষায়- ‘মসজিদে বসে জিকিরকারীকে ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন।’ (মুসলিম: ২৬৯৯) হাদিসে আরও বলা হয়েছে, কোনো মুসলিম যতক্ষণ মসজিদে সালাত ও জিকিরে রত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তার প্রতি এতটা আনন্দিত হন, প্রবাসী ব্যক্তি তার পরিবারে ফিরে এলে তারা তাকে পেয়ে যেরূপ আনন্দিত হয়। (ইবনে মাজাহ: ৮০০)
প্রাকৃতিক স্থান: পাহাড়, নদীর ধারে বা প্রকৃতির মাঝে জিকির করলে সৃষ্টিজগতও স্মরণে শরিক হয়। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পাহাড়-নদীর কাছে আল্লাহর জিকির করো, কেননা এগুলোও আল্লাহর জিকিরে শরিক হয়।’ (মুসনাদ আহমদ: ১৯৩৭৪) সুনান দারিমি (২৭৫১)-তে এসেছে, ‘পাহাড়-নদী আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে।’ সহি বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রতিটি পাথর, গাছ ও পানি আল্লাহর স্মরণে রত।’ (সহিহ বুখারি: ২৩১১) নবীজি (স.) প্রায়ই প্রাকৃতিক পরিবেশে জিকির করতেন। যেমন- হুদায়বিয়ার মরুভূমিতে (বুখারি: ২৭৩১) উহুদ পাহাড়ের নিকট (মুসলিম: ১৩৯২) ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেন- ‘প্রকৃতির মাঝে জিকির করলে সৃষ্টিজগতের সাথে একাত্মতা অনুভূত হয়।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ১/২৩৪)
আরও পড়ুন: আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় ৪ জিকির
আয়াতুল কুরসি সকালে ও রাতে: ‘যে সকালে আয়াতুল কুরসি পড়বে, সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (সহিহ বুখারি: ২৩১১)
ইস্তেগফার: ‘আমি প্রতিদিন ১০০ বার ইস্তেগফার করি।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৯১)
আল্লাহর গুণগান: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর, লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লাহ বিল্লাহ ইত্যাদি জিকিরগুলো নবীজি সবসময় করতেন। এছাড়াও মাসনুন জিকিরগুলো যতবেশি সম্ভব করতে পারেন।
তাসবিহ বা আঙুলে গণনা: আঙুলে উত্তম। হাদিসে এসেছে, ‘আঙুলগুলো কেয়ামতের দিন তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।’ (তিরমিজি: ৩৪৮৩)
নিরিবিলি পরিবেশ নির্বাচন: মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য নিরব ও পবিত্র পরিবেশে জিকির করুন। নবীজি নিরিবিলিতে জিকির করতে পছন্দ করতেন। যেমন- হেরা গুহায় (গারে হেরা) একাকী জিকির করতেন (বুখারি: ৩)। রাতে একাকী তাহাজ্জুদের পর দীর্ঘ সময় জিকিরে মশগুল থাকতেন (মুসলিম: ৭৮৩)। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘জিকিরের আসল ফল পেতে হলে অন্তরকে দুনিয়াবি চিন্তা থেকে মুক্ত করে একান্তে আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে।’ (ইহইয়া উলুমিদ্দীন (আরবি): খণ্ড ৩, পৃ: ১৭ )
অতিরিক্ত জোরে জিকির: আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (স.) মৃদু স্বরে জিকির করতেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১৭৯৯)
অশুদ্ধ উচ্চারণ: হাদিসের জিকিরগুলো বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণে পড়া উত্তম।
আরও পড়ুন: সারাদিন ৬ জিকিরের অবিশ্বাস্য ফজিলত
সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়াতুল কুরসি একবার পড়া সুন্নাহ, এতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সারাদিন নিরাপদ থাকা যায়। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর প্রতিবার ৩৩ বার করে সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, এবং ৩৩ বার আল্লাহু আকবার বলা, এরপর একবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু… পাঠ করা নবীজির শিক্ষা। এছাড়া যেকোনো সময় ১০০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়া ইমানের নবায়নের শ্রেষ্ঠ পন্থা। দিনের যেকোনো সময়ে অন্তত ১০০ বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ইস্তেগফার করা গুনাহ মাফের বড় মাধ্যম। লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লাহ বিল্লাহ জান্নাতের গুপ্তধন। এই সহজ অথচ প্রভাবশালী জিকিরগুলো নিয়মিত করলে একজন মুসলিম ঈমানের উপর অবিচল থাকতে পারেন এবং আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পান।
জিকিরে মনের উপস্থিতি জরুরি। রাসুল (স.) বলেছেন- ‘অসচেতন হৃদয়ের জিকির বৃথা।’ (তিরমিজি: ৩৫৭৮)
শেষ কথা, জিকির মানেই আল্লাহর সান্নিধ্য; মুমিনের আত্মিক নিরাময় ও আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন। রাসুল (স.) বলেন- ‘জিকির হল আল্লাহর সাথে তোমাদের কথোপকথন।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৭৫)
আসুন, আজ থেকেই জিকিরকে জীবনের অংশ বানাই। নির্ধারণ করি প্রতিদিনের জিকির সময়সূচি এবং বদলে ফেলি হৃদয়ের জগৎ।
সূত্র: সহিহ বুখারি; সহিহ মুসলিম; সুনান তিরমিজি; মুসনাদ আহমদ; সুরা আলে ইমরান; সুরা বাকারা: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।