ধর্ম ডেস্ক
০৩ জুলাই ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
মহররমের দশম দিবসকে ‘আশুরা’ বলা হয়। এই দিনকে ঘিরে ইতিহাসে বহু ঘটনা ও উপাখ্যান রচিত হয়েছে। তবে এসব ঘটনার অনেকাংশই ভিত্তিহীন, জাল বা দুর্বল সূত্র থেকে বর্ণিত। এমনকি মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত অনেক ঘটনাও সহিহ সূত্রে প্রমাণিত নয়।
অনেকেই মনে করেন আশুরার দিন কেয়ামত সংঘটিত হবে। অথচ নির্ভরযোগ্য কোনো সহিহ হাদিসে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। আবার কেউ কেউ বলেন, হজরত নূহ (আ.)-এর কিশতি আশুরার দিন জুদি পাহাড়ে থেমেছিল। এ বিষয়ে মুসনাদে আহমদে একটি বর্ণনা থাকলেও তার সনদ অত্যন্ত দুর্বল (মুসনাদে আহমদ: ১৪/৩৩৫, হাদিস: ৮৭১৭)।
আরেকটি কাহিনি হলো—আদম (আ.)-এর তাওবা আশুরার দিন কবুল হয়েছিল। এটি এসেছে আবুল কাসিম ইস্পাহানি (রহ.) সংকলিত ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’-এর একটি দুর্বল সনদে। রেওয়ায়েতটির এক রাবি দিরার ইবনে আমর সম্পর্কে ইমাম ইবনে মায়িন (রহ.) বলেছেন: “لا شيء” অর্থাৎ “কিছুই না” (লিসানুল মিজান: ৪/৩৪০)। যদিও কোনো কোনো তাবেয়ি আশুরার দিনে আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা বলেছিলেন, তবুও এর পক্ষে সহিহ সূত্র নেই।
এমনকি আশুরার দিন ঈসা (আ.)-এর জন্ম হয়েছে—এ কথাটিও ভিত্তিহীন। এটি ওই একই দুর্বল সূত্র থেকে এসেছে যেটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মহররম মাসে যেসব রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকবেন
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সহিহভাবে প্রমাণিত ঘটনা হলো হজরত মুসা (আ.)-এর ঘটনা। সহিহ হাদিস অনুযায়ী, আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহ তাআলা সমুদ্র চিরে রাস্তা তৈরি করেন, যাতে মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে পার হয়ে যান। ফেরাউন ও তার বাহিনী সেই রাস্তায় প্রবেশ করলে সমুদ্র তাদেরকে গ্রাস করে ধ্বংস করে দেয়।
এই ঘটনাটি সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিমসহ বহু হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যায় এবং একমাত্র এই ঘটনাই আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত।
আশুরার দিনেই ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে নবীজির (স.) প্রিয় নাতি হজরত হুসাইন (রা.) শাহাদাতবরণ করেন। তিনি হলেন জান্নাতি যুবকদের সরদার (তিরমিজি: ৩৭৮১)। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক বেদনার্ত অধ্যায় হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।
তবে এই করুণ ঘটনার কারণে নতুন কোনো ইবাদত বা আমল চালু করা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করে, যা এর অংশ নয়—তা প্রত্যাখ্যাত।’ (সহিহ বুখারি: ২৬৯৭)
আরও পড়ুন: কারবালার মাসে বিয়ে করা কি ঠিক? ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি জানুন
আশুরার দিন রোজা রাখা মোস্তাহাব। নবীজি (স.) মক্কা থাকাকালে এবং মদিনায় হিজরতের পরেও এ রোজা রাখতেন এবং অন্যদেরও রাখতে উৎসাহিত করতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগপর্যন্ত এটি ফরজ ছিল, পরে তা নফল হিসেবে নির্ধারিত হয়। তবে এই রোজার ফজিলত সাধারণ নফল রোজার তুলনায় অনেক বেশি।
আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘আশুরার রোজার মাধ্যমে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো—এর আগে বা পরে এক দিন অতিরিক্ত রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৫)
২০২৫ সালের পবিত্র আশুরা হবে ৬ জুলাই, রোববার। যারা দুটি রোজা রাখতে চান, তারা নিচের যেকোনো একটি গ্রহণ করতে পারেন:
এই দিনগুলোতে রোজা রাখার মধ্যে রয়েছে নবীজি (স.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ এবং গুনাহ মাফের বড় সুযোগ।
আশুরা একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, তবে তা নিয়ে ভ্রান্তি ছড়ানো নয় বরং সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করাই উত্তম। আশুরার ইতিহাসে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্ববহ ঘটনা হলো মুসা (আ.)-এর মুক্তির ঘটনা এবং হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। আমাদের উচিত এসব ঘটনার যথাযথ মর্যাদা দেওয়া, বিদআত ও ভিত্তিহীন কাহিনি থেকে দূরে থাকা এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দেখানো পথে রোজা পালন করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আশুরার রোজার ফজিলত লাভ করার তাওফিক দিন এবং বিদআতের ভয়াবহতা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।