ধর্ম ডেস্ক
০১ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫২ পিএম
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব—এসব এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, ভিডিও গেম, স্ট্রিমিং কনটেন্ট ইত্যাদির কারণে মানুষের চিন্তা, সময় ও মনোযোগের বড় অংশ জুড়ে আছে ডিজিটাল দুনিয়া। বিশেষত তরুণ সমাজ এই আসক্তির সবচেয়ে বড় শিকার। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে আত্মিক উন্নয়ন, ইবাদত ও ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহ।
তবে এ বাস্তবতায়ও কেউ চাইলে ইসলামি জীবনধারায় অটল থাকতে পারে। চাই শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
ইসলামে প্রযুক্তিকে হারাম বলা হয়নি। বরং এটা নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলে তা দ্বীনের খেদমতের জন্য এক অসাধারণ মাধ্যম হতে পারে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১)
প্রযুক্তির ভেতর রয়েছে চোখ, কানের ও মনের গুনাহের সহজ সুযোগ। হারাম কনটেন্ট, ফিতনা, অশ্লীলতা—সবই এখন মাত্র এক ক্লিক দূরে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- الْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ وَالأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الاِسْتِمَاعُ ‘দু’চোখের ব্যভিচার হলো তাকানো, দু’কানের ব্যভিচার হলো শোনা।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৫৭)
তাই অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ, সোশ্যাল মিডিয়া ও হারাম কনটেন্ট থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিন। প্রয়োজনে কম্পিউটার বা ল্যাপটব এমন জায়গায় স্থাপন করুন, যাতে সবার নজরে পড়ে। এতে করে আপনি নিয়ন্ত্রণে থাকবেন।
আরও পড়ুন: ঘরে ঘরে পাপের উপকরণ নিয়ে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী
দ্বীনি জ্ঞানার্জন, কোরআন তেলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন ও ইসলামি লেকচার শোনার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করুন। এভাবে আপনার সময়ও অপচয় হবে না, আত্মাও নির্মল থাকবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ‘আল্লাহর জিকিরেই অন্তর শান্ত হয়।’ (সুরা রাদ: ২৮)
প্রতিদিন ১০–১২ ঘণ্টা পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা শুধু চোখের ক্ষতি করে না, বরং ইবাদতের প্রতি উদাসীন করে তোলে। তাই আত্মাকে প্রশান্ত করুন জিকিরের মাধ্যমে। আর নামাজের সময় অবশ্যই নামাজে চলে যাবেন। নামাজে অভ্যস্থ ব্যক্তি সহজে গুনাহে জড়াতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন- اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡكَرِ ‘নিশ্চয় সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে।’ (সুরা আনকাবূত: ৪৫)
আজকের শিশু, কিশোরেরা প্রযুক্তিতে জন্ম নিচ্ছে। তারা যদি শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ না শেখে, তাহলে ভবিষ্যতে ইসলামি মূল্যবোধ শেখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তাদেরকে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিন, তা-ও সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। এটি অভিভাবকের দায়িত্ব। এ দায়িত্বে অবহেলা করা যাবে না। হাদিসে এসেছে- كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্বের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি: ৮৯৩)
শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার আগে তাদের ধর্মীয় নৈতিকতা শেখান, তাদের সঙ্গে সময় কাটান এবং ধর্মীয় কনটেন্ট দেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
আরও পড়ুন: চোখ-কানের ফিতনা থেকে বাঁচার দোয়া
যেকোনো আসক্তি থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত হলো আত্মসমালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ। এটাই আসল বুদ্ধিমানের কাজ। রাসুল (স.) বলেন- الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ ‘বুদ্ধিমান সেই, যে নিজের আত্মার হিসাব নেয় এবং পরকালের জন্য আমল করে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
প্রতিদিন কিছু সময় নীরবে আত্মসমালোচনা করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন—আজ আমি কত সময় প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যয় করেছি, আর কত সময় আল্লাহর পথে?
দুর্বল মুহূর্তে একজন ভালো বন্ধু আপনাকে ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ ‘মানুষ তার বন্ধুর ধ্যান-ধারণার অনুসারী হয়ে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৩৭৮)
তাই প্রযুক্তি ব্যবহার ও ইসলামি জীবন নিয়ে সচেতন বন্ধুদের সঙ্গে থাকুন। কোনো ইসলামি অনলাইন গ্রুপে যুক্ত থাকলে ভালো দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।
ফেতনার ছড়াছড়িতে বেশি বেশি ইস্তিগফার অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমল। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবিল কবরি, ওয়া মিন আজাবিন নারি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহয়া ওয়াল মামাতি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাসিহিদ দাজ্জালি।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের শাস্তি থেকে, জাহান্নামের শাস্তি থেকে, জীবন ও মরনের ফিতনা থেকে এবং মাসিহ দাজ্জালের ফিতনা থেকে ‘ (বুখারি: ১৩৭৭)
প্রযুক্তি অভিশাপ নয়, তবে ভুল ব্যবহারে তা অভিশাপে পরিণত হতে পারে। ইসলাম চায় আমরা ভারসাম্য বজায় রাখি—জ্ঞানার্জন করি ও সুশিক্ষিত হই, কিন্তু আত্মাকে যেন না হারাই। ইসলামি আদর্শে দৃঢ় থাকতে চাইলে চাই নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি ব্যবহার, জিকিরে মুখর অন্তর এবং সময়মাফিক ইবাদত। স্মার্ট ডিভাইস হাতে থাকলেও যেন হৃদয়ে থাকে আল্লাহর ভয়। প্রযুক্তির স্রোতে নয়, আমরা যেন চলি আল্লাহর পথেই। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।