ধর্ম ডেস্ক
০৮ জুন ২০২৫, ০৫:০৬ পিএম
ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব। এই দিনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য পশু কোরবানি করা হয়। কিন্তু এটি শুধু পশু জবাই করাই নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে বহু গভীর শিক্ষা ও মূল্যবোধ, যা প্রতিটি মুসলমানের জীবন ও সমাজের জন্য অপরিহার্য।
কোরবানি আমাদের শেখায় আল্লাহর আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনায় দেখা যায়, তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে নিজস্ব ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। ঘটনাটি পবিত্র কোরআনে এসেছে এভাবে- ‘হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়ে আদেশ মান্য করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। (সুরা সাফফাত: ১০২-১০৩)
আজকের মুসলমানদেরও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর কথা মেনে চলতে হবে।
কোরবানি হলো আত্মত্যাগের প্রতীক। নিজের প্রিয় ও মূল্যবান কিছু ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করার বার্তা দেয় এটি। আমরা জানতে পারি, জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলছেন- ‘মানুষ কি মনে করে যে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে কেবল এতটুকু বললেই যে, আমরা ঈমান এনেছি। অথচ তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমরা তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা নিয়েছি। অতএব আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন কারা (তাদের ঈমানের দাবিতে) সত্যবাদী এবং অবশ্যই জেনে নেবেন কারা (তাতে) মিথ্যাবাদী।’ (সুরা আনকাবুত: ২-৩)
আরও পড়ুন: কীভাবে কোরবানি করলে কবুল হয়
কোরবানির গোশত দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এটি আমাদের শেখায় দরিদ্র-দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের সম্মান বজায় রেখে সাহায্য করতে হবে। নবীজির (স.) সুন্নতে এ কারণে সমাজে সৌহার্দ্য ও সাম্য বজায় থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অতঃপর তোমরা উহা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থকে আহার করাও। (সুরা হজ: ২৮)। রাসুলুল্লাহ (স.) কোরবানির গোশত সম্পর্কে বলেছেন- ‘তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।’(বুখারি: ৫৫৬৯)
কোরবানির পশুদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করা আবশ্যক। তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা কাম্য নয়। পশুদের প্রতি করুণা ও দয়া কোরবানির মূল শিক্ষা। এটি আমাদের জীবনে ন্যায় ও দয়ালু হওয়ার গুরুত্ব বোঝায়। পশুপাখির প্রতি মমতা দেখানোর শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ের ওপর উত্তম আচরণ ফরজ করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে। আর যখন জবাই করবে তখন দয়ার সঙ্গে জবাই করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার জবাইকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।’ (মুসলিম: ১৯৫৫: নাসাঈ: ৪৪১১; মেশকাত: ৪০৭৩)
আরও পড়ুন: কোরবানির গোশত বণ্টনে যে ভুল করা যাবে না
কোরবানি সমাজে শৃঙ্খলা এবং ঐক্য বজায় রাখে। সাধারণত মানুষ স্বার্থহীনভাবে কোনো কিছু দেয় না; প্রতিটি দান বা সহযোগিতা কোনো না কোনো রূপে প্রত্যাবর্তনের আশায় করা হয়। ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু কেনা, কোরবানি দেওয়া এবং মাংস বণ্টন করা—এই সব কার্যক্রম একটি সামাজিক প্রত্যাবর্তন কাঠামোর মধ্যে সংঘটিত হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি নিরবচ্ছিন্ন সামাজিক চক্র তৈরি করে, যেখানে পারস্পরিকতা একটি মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য রাসুল (স.) ঘোষণা করেছেন- ‘আমাকে ইয়াওমুল আজহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কোরবানি করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ৬৫৭৫)
তাই সামাজিক ঐক্যের এই প্রতীক থেকে সমগ্র মুসলিম জাতিকে একতাবদ্ধ ও মিলেমিশে থাকার শিক্ষা নিতে হবে কোরবানি থেকে।
কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয়; এটি জীবনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ও আদর্শের প্রতীক। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ত্যাগ, দরিদ্রদের সহায়তা, পশুদের প্রতি করুণা এবং সমাজের ঐক্য–এই পাঁচটি মূল শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করতে পারি। ঈদুল আজহার প্রকৃত মানে উপলব্ধি করে আমরা এই শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করলে আমাদের সমাজ হবে আরও উন্নত ও মানবিক।