images

ইসলাম

কোরবানির সময় ৩ দিন নাকি ৪ দিন?

ধর্ম ডেস্ক

০৮ জুন ২০২৫, ১২:৩৬ পিএম

কোরবানির সময়সীমা হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের আমলের আলোকে নির্ধারিত। ঈদুল আজহার দিনের পরেও নির্দিষ্ট কয়েকদিনব্যাপী কোরবানি করা জায়েজ। সেটি কি তিন দিন নাকি চার দিন? এই প্রতিবেদনে দলিলসহ তুলে ধরা হলো কোরবানির সঠিক সময় কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

কোরবানির সময়

বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, কোরবানির সময়কাল হলো জিলহজের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। এই তিন দিনের যেকোনো দিন কোরবানি করা জায়েজ। তবে প্রথম দিন কোরবানি করা উত্তম। তারপর দ্বিতীয় দিন। তারপর তৃতীয় দিন। জিলহজ মাসের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পর কোরবানি করা শুদ্ধ নয়। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/২৯৬) 

আর ঈদুল আজহার নামাজের আগে কোরবানি করা বৈধ নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আজ আমরা এই দিনে প্রথমে নামাজ আদায় করি, তারপর কোরবানি করি। যে ব্যক্তি এমনটি করে, সে আমাদের সুন্নাতের অনুসরণ করল।’ (সহিহ বুখারি: ৫৫৪৫)

কোরবানির সঠিক সময় তিন দিন নাকি চারদিন?

রাসুল (স.) বলেন- من ضحى منكم فلا يصبحن بعد ثالثة وفي بيته منه شيء ‘তোমাদের মধ্যে যারা কোরবানি করবে, তারা যেন তৃতীয় দিন সকাল হওয়ার পর পর্যন্ত কোরবানির গোশত ঘরে রেখে না দেয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫৫৬৯)
এই হাদিস অনুযায়ী ‘তৃতীয় দিন’ পর্যন্ত কোরবানির মাংস সংরক্ষণে একসময় নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এই হাদিস প্রমাণ করে, কোরবানির সময়সীমা তিন দিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কারণ তার বেশি হলে গোশত রাখার সময়ও বাড়ানো হতো।

পরে নবীজি কোরবানির গোশত সংরক্ষণের অনুমতি দিয়েছেন। এই অনুমতি সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদিস রয়েছে। হাদিসগুলোর কোথাও এ কথা নেই যে, তিনি গোশত সংরক্ষণের অবকাশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ দিনও কোরবানি করার অনুমতি দিয়েছেন। (শরহু মুখতাসারিত তহাবি, জাসসাস ৭/৩৩২-৩৩৩; আলমুগনি, ইবনে কুদামা: ১৩/৩৮৭)

আরও পড়ুন: কোরবানির গোশত বণ্টনে যে ভুল করা যাবে না

সাহাবি ও ইমামদের বক্তব্য, আমল

আনাস (রা.) বলেন- الذبح بعد العيد يومان ‘ঈদের পর দুই দিন কোরবানি করা যায়।’ (দ্র. আহকামুল কোরআন, তাহাবি: ২/২০৬)
ইবনে ওমর (রা.) বলেন- الأضحى يومان بعد يوم الأضحى    ‘ঈদের দিন এবং এরপর আরও দুই দিন।’ (দ্র. মুয়াত্তা: ২০৩৮)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- الأضحى ثلاثة أيام ‘আজহা (কোরবানি) তিন দিন।’ (দ্র. আল জাওহরুন নাকি ৯/২৯৬)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন-    الأضحى ثلاثة أيام    ‘কোরবানি তিন দিন।’ (আল মুহাল্লা, ইবনে হাযম)
আলী (রা.) বলেন- النحر ثلاثة أيام أفضلها أولها ‘কোরবানির সময় তিন দিন, প্রথম দিনই উত্তম।’ (মুয়াত্তা মালিক, আহকামুল কুরআন)
ওমর (রা.) বলেন- إنما النحر في هذه الثلاثة الأيام ‘নহার (কোরবানি) কেবল এই তিন দিন।’ (আল মুহাল্লা, ইলাউস সুনান)

ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) প্রমুখ ফিকহ বিশারদগণের মতে وقد حصل الاتفاق والسنة في الثلاث কোরবানির সময়  সীমিত তিন দিনে: ১০ জিলহজ (ঈদের দিন), ১১ জিলহজ, ১২ জিলহজ (সূর্যাস্ত পর্যন্ত) (শরহু মুখতাসারিত তাহাবি ৭/৩৩৩)

আরও পড়ুন: যেভাবে কোরবানি করলে কবুল হয়

তবে, কোনো কোনো আহলে ইলম কোরবানির সময় চার দিন হওয়ার কথাও বলেছেন। আতা ইবনে আবি রাবাহ, হাসান বসরি, ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ), এমনকি ইমাম শাফেয়ি (রহ)-ও এই মত গ্রহণ করেছেন। সেটিও একটি ইজতিহাদি মত।

এই দুই মতের কেউ কাউকে ভিত্তিহীন বলেননি। শরিয়তের যে বিষয়গুলোতে উভয় দিকে দলিল থাকার কারণে ইজতিহাদগত মতভেদ হয়েছে, সেসব বিষয়ে অন্য মতকে ভিত্তিহীন বলা অপরিপক্কতার পরিচয় বহন করে।

‘চার দিন’ মতটি কেন দুর্বল?

জুবাইর ইবনে মুতইম (রা.) সূত্রে একটি বর্ণনা রয়েছে। যেটা বলছে কোরবানি চার দিন। এই হাদিসের সনদ মুনকাতি (বিচ্ছিন্ন), অর্থাৎ রাবিদের মাঝে ধারাবাহিকতা নেই। হাদিস শাস্ত্রে মুনকাতি হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়, বিশেষত যখন সহিহ ও মুতাওয়াতির হাদিসের বিপরীতে হয়।

উপরন্তু, এই হাদিসের আলোচিত অংশ অন্যান্য শক্তিশালী সূত্রে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ এটি ‘শায’ (বিচ্যুত) হিসেবে চিহ্নিত। মূল হাদিসগুলো কোরবানি ৩ দিনের সীমা নির্ধারণ করে। হজরত ওমর, আলী, ইবনে ওমর, আব্বাস, আবু হুরায়রা (রা.) সকলেই বলেন- ‘কোরবানি তিন দিন, তার বেশি নয়’ এ ধরনের আমলকে হাদিসের পরিভাষায় বলে ‘মারফু হুকমি’, যা রাসুল (স.) থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। 

ইমাম জাসসাস স্পষ্ট বলেন, ‘তিন দিনের ওপর ইজমা (ঐকমত্য) এবং সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত, তাই এর বাইরে কিছু গ্রহণযোগ্য নয়।’ (শরহু মুখতাসারিত তাহাবি: ৭/৩৩৩)

যারা চার দিনের মত বলেছেন—আতা ইবনে আবি রাবাহ, হাসান বসরি, ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.)—তাঁরা সাহাবি নন; তাঁদের মত ইজতিহাদি, দলিলভিত্তিক সর্বসম্মত নয়। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) এই মত গ্রহণ করলেও তাঁরা কেউ তিন দিনের মতকে ‘ভিত্তিহীন’ বলেননি। বরং উভয় দিকেই কিছু দলিল থাকায় একে ফিকহি মতভেদ বলা হয়, তবে তিন দিনের মত অধিকতর সহিহ ও শক্তিশালী।

কোরবানি যথাসময়ে না দিলে করণীয়

ওয়াজিব কোরবানি যথাসময়ে (৩ দিনের মধ্যে) দিতে না পারা ব্যক্তি কোরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কোরবানি দেওয়া হয়নি তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৪; ফতোয়ায়ে কাজিখান: ৩/৩৪৫)

যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০২; আদ্দুররুল মুখতার; ৬/৩২০-৩২১)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামি দিক-নির্দেশনা ও আদব মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।