images

ইসলাম

কোরবানির পশু নিয়ে সেলফি-ছবি শেয়ার, ইসলাম কী বলে

ধর্ম ডেস্ক

০৩ জুন ২০২৫, ০৪:৩৯ পিএম

কোরবানির ঈদ যত ঘনিয়ে আসে, ততই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ায় কোরবানির পশু নিয়ে সেলফি, ভিডিও আর ছবি। গরুর গলায় মালা, পেছনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ছবি—এ যেন উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোরবানির মতো ইবাদতের প্রাণকে এমনভাবে প্রদর্শন করা শরিয়তের দৃষ্টিতে কতটা গ্রহণযোগ্য?

কোরবানি ইবাদত, শো অফ নয়

কোরবানি নিছক পশু জবাই নয়, এটি আল্লাহর জন্য একটি ইবাদত ও তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। কোরআনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭)

এই আয়াত প্রমাণ করে, ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টিই মুখ্য। যদি কারও ছবি পোস্ট করার পেছনে উদ্দেশ্য হয় গরুর দাম, আকার বা সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বাহাদুরি দেখানো, তবে তা রিয়া (লোক দেখানো) হিসেবে গণ্য হবে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।

রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক নিয়ে যতটা ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো বিষয়ে ততটা ভীত নই।’ সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ছোট শিরক কী? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। আল্লাহ কেয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান প্রদানের সময় বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখাতে, তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছে তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি না?’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৫২৮)

আরও পড়ুন: আলহাজ উপাধির জন্য হজ করলে পরিণতি ভয়াবহ

রাসুল (স.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের নিকট প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোনো আমল করে— আল্লাহ তাআলা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন। (বুখারি: ২/৯৬২; মুসলিম: ২/৪১২; তিরমিজি: ২/৬১; ইবনে মাজাহ: ২/৩১০; মুসনাদে আহমদ: ৩/৪০; শুয়াবুল ঈমান: ৫/৩৩০)

হাদিসে মর্মার্থ হলো- কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা সব মানুষের সামনে তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে তাকে অপমান ও অপদস্থ করবেন।

প্রদর্শনপ্রিয়তা ইবাদত নষ্ট করে

ইসলামে রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত এমন গুনাহ, যা ইবাদতকে বাতিল করে দিতে পারে। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) কেয়ামতের দিন লোক-দেখানো আমলকারীদের বিচারের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন, যাতে একজন শহীদ (আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী), একজন কোরআনের শিক্ষক ও একজন দানবীরের আলোচনা এসেছে। যারা খ্যাতি ও সুনামের মোহে জিহাদ, কোরআন শিক্ষা ও দান করত। তারা তাদের আমলের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তাদের বলেন, ‘তোমরা যা চেয়েছ পৃথিবীতে তা পেয়েছ। সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের কোনো প্রাপ্য নেই।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৫২৭)

তাই ইবাদতের সঙ্গে যদি লোক দেখানোর মনোভাব যুক্ত হয়, সেই ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুন: নেক আমল নষ্টকারী ৬ গুনাহ থেকে সাবধান

কোরবানির পশু নিয়ে ছবি তোলা কি হারাম?

মূলত কোরবানির পশুর ছবি তোলা বা সেলফি নিজেই হারাম নয়, তবে এর উদ্দেশ্য ও প্রভাবই এখানে বিবেচ্য। ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ছবি তোলা হয় কেবল প্রয়োজনে, অন্যদের কষ্ট না দিয়ে, অহংকার ছাড়া—তবে তা জায়েজ, অর্থাৎ হারাম নয়। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য হয় ‘লোক দেখানো’, ‘আমি কত বড় গরু কোরবানি দিচ্ছি’ তা জাহির করা, তাহলে তা নিঃসন্দেহে নাজায়েজ এবং বড় গুনাহের কারণ হবে। মূলত অযথা শুধুই ফটোশুট শরিয়তের প্রয়োজনের ক্ষেত্র নয়, তাই তা পরিহার করাই শ্রেয়। 

বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেন, ‘কোরবানির পশু নিয়ে অহংকার, দাম জাহির করে গর্ব করা ইবাদতের অপমান। ইবাদত গোপনে করাই উত্তম, যাতে তা রিয়ার কবলে না পড়ে।’ (ইসলামকিউ, ফতোয়া: ৭০৩৫)

সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরুর দাম, আকার, জাত, কতজন মিলে কোরবানি করছেন—এসব নিয়ে অহেতুক প্রতিযোগিতা দেখা যায়। এতে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে এবং ঈদের আনন্দ বিষণ্নতায় পরিণত হয়। ইসলাম এ ধরনের অসংবেদনশীল আচরণে নিরুৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'হে বিশ্বাসী! কোন সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা নারীদের উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম।’ (হুজরাত: ১১) অতএব, ইসলামের নির্দেশনা হলো- নিজের বড়লোকি দেখানো বা গরিবদের উপহাস করার মতো আচরণ সমাজে বিভ্রান্তির পথ খুলে দেয়; তাই এসব আচরণ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে।

আরও পড়ুন: ১৪ পাপের শাস্তি ‍দুনিয়ায় দেওয়া হয়

ইবাদতকে হাস্যরসে রূপান্তর করবেন না

ইবাদতকে কৌতূক বা বিনোদনে পরিণত করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। কোরআনে এমন আচরণকে জাহান্নামীদের স্বভাব বলা হয়েছে- ‘যারা তাদের দ্বীনকে ক্রীড়া ও তামাশা বানিয়েছে... আজ আমি তাদের ভুলে যাব।’ (সুরা আরাফ: ৫১) তাই, কোরবানির পশু নিয়ে এমন আচরণ ইবাদতের পবিত্রতা নষ্ট করে এবং ঈমানের জন্য তা হুমকিস্বরূপ।

অতএব, কোরবানি আল্লাহর জন্য করবেন। এটি প্রচার করার মতো কিছু নয়। ইসলাম ইবাদতকে গোপনে, বিনয়ের সাথে সম্পন্ন করতে উৎসাহ দেয়। কোরবানির মতো পবিত্র ইবাদতের সঙ্গে অহংকার, লোক দেখানো বা অন্যকে অপমান করার মতো বিষয় জড়িয়ে পড়লে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হারিয়ে যায়। 

তাই গরু বা মহিষ বা ছাগলের ছবি তোলা বা শেয়ার করা একেবারে হারাম না হলেও, তা রিয়া বা অহংকারের আশঙ্কা থাকায় পরিহার করাই শ্রেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শরিয়তের সকল নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।