ধর্ম ডেস্ক
২৭ মে ২০২৫, ০৪:০০ পিএম
ইসলামে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখের মধ্যে আদায় করা হয়। গরু, মহিষ, উট—এসব বড় পশুতে শরিক হয়ে কোরবানি করার সুযোগ রয়েছে। গরু বা মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারে। তবে প্রশ্ন আসে—এই শরিকদের ইচ্ছা, নিয়ত ও উদ্দেশ্য কি এক হতে হবে?
কোরবানির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো বিশুদ্ধ নিয়ত। কোরবানি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করতে হবে। তাই শরিকে কোরবানি করলে সকল অংশীদারের নিয়ত যেন বিশুদ্ধ হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ শুধু মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কোরবানি গ্রহণ করেন।’ (সুরা মায়েদা: ২৭) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট কোরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।’ (সুরা হজ: ৩৭)
অংশীদারিত্বে কোরবানি করার ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দুই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। ১. আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত ও ২. হালাল টাকায় কোরবানি। কারো মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য থাকলে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। হানাফি ফিকহের প্রখ্যাত কিতাবগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- ‘যদি গরুতে সাতজন শরিক হয় এবং তাদের মধ্যে কেউ কোরবানির নিয়ত না করে, বরং কেবল মাংস পাওয়ার জন্য শরিক হয়, তবে সবার কোরবানি বাতিল হয়ে যাবে।’ (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০০; আল হিদায়া: ১/৩৬১)
আরও পড়ুন: ১০ কারণে কোরবানি শুদ্ধ হয় না
আবার এক শরিকের কোরবানি হারাম টাকায় হলে অন্য শরিকদের কোরবানিও সহিহ হবে না। তাই শরিক নির্বাচন করতে হয় প্রত্যেককে ভালোভাবে জেনে-বুঝে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮; কাজিখান: ৩/৩৪৯; সহিহ মুসলিম: ২২১৫)
তবে হ্যাঁ, কারো নিয়তে গণ্ডগোল বা উপার্জন হারাম হওয়ার বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি অশুদ্ধ হবে না; শুধু ওই লোকের কোরবানিই অশুদ্ধ হবে, যার নিয়ত অশুদ্ধ বা কোরবানির টাকা হারাম। (তাফসির: সুরা বাকারা: ২৮৬)
সমমনা বলতে বোঝায়, সবার উদ্দেশ্য একই হওয়া, অর্থাৎ— সকল অংশীদার কোরবানির নিয়ত করবে; কেবল মাংস পাওয়ার বা অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বা অন্যকোনো উদ্দেশ্যে কেউ শরিক হবে না। সবার উপার্জন হালাল হবে। উদাহরণস্বরূপ, ৭ জন গরু কোরবানি দিলেন, ৫ জন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানির নিয়ত করলেন, ১ জন নিয়ত করলেন সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ রাখা বা সন্তানদের খুশি করার জন্য আর ১ জন শুধু মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানি করলেন—এই কোরবানি বাতিল। একইভাবে জেনেশুনে একজন হারাম উপার্জনকারীকে কোরবানিতে শরিক করলে সবার কোরবানিই বাতিল হয়ে যাবে।
কেউ দুই ভাগ বা তিন ভাগে শরিক হলে, আর কেউ এক ভাগের জন্য শরিক হলে—এরকম পার্থক্য জায়েজ। কিন্তু এক সপ্তমাংসের চেয়ে কম জায়েজ নেই। অর্থাৎ ‘সাতজনে মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানিই সহিহ হবে না।’ (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
আরও পড়ুন: কোরবানি কি ২-৪-৬ ভাগে করা যায়?
অনেক সময় হারাম উপার্জনকারী আত্মীয় হওয়ার কারণে বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকে না কিংবা বাদ দিতে গেলে সমাজে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশংকা থাকে। অথচ আলেমদের পরামর্শ অনুযায়ী, একজন বেনামাজিকেও কোরবানিতে অংশীদার বানানো উচিত নয়, প্রয়োজনে একাকী কোরবানি করা উত্তম। কিন্তু আত্মীয়তা রক্ষা বা বিশৃঙ্খলা এড়ানোর স্বার্থে তাকে শরিক করতে বাধ্য হলে আপনার কোরবানি শুদ্ধ হবে; শুধু ওই লোকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার চাপিয়ে দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে। (সুরা বাকারা: ২৮৬)
তবে, এক্ষেত্রেও আলেমদের পরামর্শ হলো- যথাসম্ভব হারাম উপার্জনকারীকে অংশীদার না করার চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে একা একটি ছাগল কোরবানি করার জন্য সরে পড়বেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে অযথা সন্দেহের দিকে ঠেলে দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এমনকি আপনার এই চেষ্টায় ঘাটতি থাকলে কবুল না হওয়ার আশংকাই বেশি। তাই সতর্কতাই মুমিনের অবলম্বন হওয়া উচিত।
শেষ কথা, কোরবানির অংশীদারদের সকলের উদ্দেশ্য ও নিয়ত হতে হবে এক—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আর সবার কোরবানির টাকা হতে হবে হালাল। কেউ মাংস লাভের আশায় শরিক হলে বা অন্য কোনো ইবাদতের নিয়ত করলে কিংবা জেনেশুনে হারাম উপার্জনকারীকে শরিক করলে পুরো কোরবানিই বাতিল হয়ে যায়। তাই শরিকানা কোরবানিতে নিয়ত ও উদ্দেশ্য যাচাই করে নেওয়া জরুরি।