images

ইসলাম

কোরবানির প্রতিটি ধাপে শরিয়তের নির্দেশনা জানুন

ধর্ম ডেস্ক

২১ মে ২০২৫, ০৬:২৮ পিএম

কোরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আদায় করা হয়। শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কোরবানির জন্য শরিয়তের নিয়মগুলো অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। এই প্রতিবেদনটিতে কোরবানির প্রতিটি ধাপে প্রয়োজনীয় শরিয়ত নির্দেশনা কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে তুলে ধরা হলো।

১. কোরবানি দেওয়ার নিয়ত ও যোগ্যতা

প্রাপ্তবয়স্ক, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়। কোরবানির সময় হৃদয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত রাখা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর গোশত বা রক্ত, তবে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭)

২. কোরবানির জন্য পশু নির্বাচন

কোরবানির পশুর বয়স ও শারীরিক অবস্থা শরিয়তে স্পষ্টভাবে বর্ণিত। ছয় প্রকার পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ বা বৈধ। তা হলো- উট, গরু, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া ও মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু দিয়ে কোরবানি করা বৈধ নয়। (হেদায়া: ৪/৪৪৮) প্রত্যেক শ্রেণির বয়সও নির্ধারিত। নবীজি বলেছেন, তোমরা (কোরবানির জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত জবাই করো না। (মুসিন্নাহ হলো- ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু-মহিষ এবং ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর (শরহুন নববি) যদি সম্ভব না হয় তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা। (সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩)
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কোরবানি শুদ্ধ নয়: এক চোখে অন্ধ, অসুস্থ যেটা সুস্পষ্ট, খোঁড়া যেটা সুস্পষ্ট এবং অত্যন্ত দুর্বল যেটা কঙ্কালসার।’ (ইবনে মাজাহ: ৩১৪৪)

৩. কোরবানির সঠিক সময়

কোরবানি শুরু হয় ঈদুল আজহার দিনের নামাজের পর থেকে। শেষ সময় হলো জিলহজ মাসের ১২ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ ১০ জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু করে জিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই (প্রথম দিনে) কোরবানি করা উত্তম। জিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পর আর কোরবানি করার সুযোগ থাকে না। (মুয়াত্তা মালেক: ১৮৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৮, ২৩; হিন্দিয়া: ৫/২৯৫)

আরও পড়ুন: কোরবানি কি ২-৪-৬ ভাগে করা যায়?

৪. কোরবানি করার নিয়ম ও আদব

জবাইয়ের সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা আবশ্যক। জবাইকারী মুসলমান হওয়া উচিত। ধারালো ছুরি দিয়ে দ্রুত ও কষ্ট যাতে কম হয় সেভাবে জবাই করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা যখন পশু জবাই করবে, ভালোভাবে (ছুরি) ধারালো করে নাও এবং পশুকে কষ্ট কম দাও।’ (সহিহ মুসলিম: ১৯৫৫)

৫. পশুর জবাইয়ের সময় কমপক্ষে ৩টি রগ কাটা

পশু জবাই শুদ্ধ হওয়ার জন্য গলার চারটি রগ কাটা জরুরি: ১. কণ্ঠনালি, ২. খাদ্যনালী, ৩. দুই পাশের মোটা রগ, যাকে ওয়াজদান বলা হয়। এই চারটি রগের মধ্যে যেকোনো তিনটি কাটা হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দুটি কাটা হয় তবে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (হেদায়া: ৪/৪৩৭)

৬. গোশত বিতরণ ও ব্যবহার

কোরবানি করা পশুর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম: নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, এবং গরিবদের মধ্যে। গোশত বা চামড়া বিক্রি করা শরিয়তে নিষিদ্ধ। জবাইকারীকে পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা-পয়সা ইত্যাদি দিতে হবে, কোনো অবস্থাতেই কোরবানির পশুর কোনো কিছু দেওয়া যাবে না। ‘অবশ্য ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকে গোশত খাওয়ানো যাবে।’ (আহকামুল কুরআন জাসসাস: ৩/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক: ৮/৩২৬)

আরও পড়ুন: যৌথ পরিবারে কোরবানি, সচরাচর ভুল ও সঠিক নিয়ম

৭. নারীদের জন্য কোরবানি

পুরুষের মতো সামর্থ্যবান নারীদের ওপরও কোরবানি ওয়াজি। নারীরা নিজ নামে কোরবানির পশু জবাই করতে পারবেন। তবে নিজের হাতে জবাই করার ক্ষেত্রে শৈল্য ও সুবিধা বিবেচনায় পুরুষের সাহায্য নেয়া উত্তম। (বুখারি: ২৩০৪)

৮. শরিকে কোরবানির নিয়ম

কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭) অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। পা ও মাথার ক্ষেত্রেও একই বিধান। তবে কেউ যদি নিজের ভাগের অংশ অন্যজনকে দিয়ে দেয়, তাতে সমস্যা নেই (আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩১৭, কাজিখান: ৩/৩৫১)

৯. কোরবানির পর করণীয়

কোরবানির পর কোরবানির স্থানের ময়লা পরিচ্ছন্ন করা, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, তাকওয়ার সাথে জীবন পরিচালনা করা এবং গরিব ও অসহায়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ আল্লাহ তাআলা সবকিছুতে বান্দার তাকওয়াই গ্রহণ করেন। কোরবানির মতো ইবাদতের মূল শিক্ষাই হলো তাকওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর গোশত বা রক্ত, তবে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭)

কোরবানির পূর্ণ সাওয়াব অর্জনের জন্য শরিয়তের প্রতিটি নির্দেশনা মানা আবশ্যক। কোরবানি শুধু পশু জবাই নয়, এটি আল্লাহর পথে ত্যাগ, ইমান ও তাকওয়ার প্রকাশ। তাই কোরআন-হাদিসের আলোকে শুদ্ধভাবে কোরবানি করার এই গাইড অনুসরণ করুন।