ধর্ম ডেস্ক
১৯ মে ২০২৫, ০১:৩৭ পিএম
ফজরের নামাজ ইসলামের পাঁচটি ফরজ নামাজের একটি। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে মুসলমানগণ এই নামাজ আদায় করেন। এই নামাজে সচরাচর এশার বিতিরের মতো কুনুত পড়া হয় না। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিপদ মসবিতে বিশেষ পরিস্থিতিতে ফজর নামাজেরই একটি অংশ হলো দোয়া কুনুত বা কুনুতে নাজেলা, যা দ্বিতীয় রাকাতে রুকু থেকে উঠে পড়া হয়।
আরবি قُنُوْت কুনুত শব্দের অর্থ বিনম্র আনুগত্য। نَازِلَة নাজেলা শব্দের অর্থ আকস্মিক দুর্ঘটনা, বিপদ-মুসিবত। পরিভাষায় কুনুতে নাজেলা হলো সেই দোয়া- যা মুসলমানদের উপর প্রাকৃতিক কিংবা কাফিরদের চাপিয়ে দেওয়া বিপদ-মসিবত ও অত্যাচারের সময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর কাছে সমূহ বিপদ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করা। এই দোয়া ফজরের নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে রুকু থেকে উঠে (রব্বানা ওয়ালাকাল হামদ বলার পর) পড়া হয়। প্রসঙ্গত, এশার নামাজে যেই কুনুত পড়া হয় সেটি হলো কুনুতে রাতেবাহ বা কুনুতে গাইরে নাজেলাহ।
রাসুলুল্লাহ (স.) বিপদ আপতিত হলে ফজরের নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময় কুনুতে নাজেলা পড়েছেন। (সহিহ বুখারি: ২/৬৫৫, তাহাবি: ১/১৭৪, সহিহ মুসলিম: ১/২৩৭) কুনুতে নাজেলা রহিত হয়নি বরং তা এখনো বহাল রয়েছে। মুসলমানদের দুর্যোগ কালে ফজরের নামাজে ইমাম কুনুত পড়বে। (এলাউস সুনান: ৬/৮১) হানাফি মাজহাবমতে, কাফের, মুশরিক ও জালেমদের পক্ষ থেকে বা আসমানি কোনো বিপদ এলে কুনুতে নাজেলা পড়া উচিত। (ফতোয়ায়ে শামি: ২/৪৪৮-৪৪৯)
কুনুতে নাজেলা একটি প্রমাণিত আমল। সহিহ সূত্রে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একটি কাফের গোষ্ঠী নবী (স.)-এর ৭০ জন (কোরআন হাফেজ) সাহাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। অথচ তখন এদের সাথে মুসলিমদের সন্ধি ছিলো। এই ঘটনায় রাসুল (স.) ভীষণ কষ্ট পান। তাই তিনি এদের বিরুদ্ধে এক মাস পর্যন্ত কুনুত (নাজেলা) পড়েছেন। (সহিহ বুখারি: ৩১৭০ সহিহ মুসলিম: ৬৭৭)
আরও পড়ুন: দোয়া কুনুত না জানলে বিতিরে এই দোয়া পড়ুন
ফজরের নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে রুকু থেকে উঠে ইমাম আওয়াজ করে কুনুতে নাজেলা পড়বেন, এ সময় মুসল্লিরা আস্তে আস্তে আমিন বলবেন। দোয়া শেষে নিয়ম অনুযায়ী নামাজের অবশিষ্ট সেজদা, শেষ বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমে নামাজ শেষ করবেন। (এলাউস সুনান: ৬/৮১)
কুনুতে নাজেলা পড়ার সময় হাত বাঁধা এবং ছেড়ে দেওয়া উভয় ধরনের কথা পাওয়া যায়। তাই উভয় মতের ওপর আমলের অবকাশ আছে। তবে হাত ছেড়ে দেওয়া উত্তম। (এমদাদুল ফতোয়া: ১/৪৫৮; ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: ১৬/৩৭৮)
শরিয়তের বিধান অনুযায়ী, কুনুতে নাজেলা নারী ও মুনফারিদ (একাকি নামাজ আদায়কারীরা)-ও পড়তে পারবে। তবে নারীরা জোড়ে আওয়াজ পড়বে না। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যাহ: ৬/২৪)
১. নবী করিম (স.) বিভিন্ন বিপদ-আপদের সময় দোয়া কুনুত পড়তেন।
২. এটি আল্লাহর সাহায্য লাভের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম।
৩. দোয়া কুনুত হলো আল্লাহর কাছে সরাসরি সাহায্য প্রার্থনার দোয়া, যেটি নামাজেই পড়া হয়।
আরও পড়ুন: উচ্চারণ ও অর্থসহ দোয়া কুনুত
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَنَا ، وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ ، وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِهِمْ ، وَانْصُرْهُمْ عَلَى عَدُوِّكَ وَعَدُوِّهِمْ، اللَّهُمَّ الْعَنْ كَفَرَةَ أَهْلِ الْكِتَابِ الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِكَ ، وَيُكُذِّبُونَ رُسُلَكَ ، وَيُقَاتِلُونَ أَوْلِيَاءَكَ اللَّهُمَّ خَالِفْ بَيْنَ كَلِمَتِهِمَ ، وَزَلْزِلْ أَقْدَامَهُمْ، وَأَنْزِلْ بِهِمْ بَأْسَكَ الَّذِى لاَ تَرُدُّهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُثْنِى عَلَيْكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّى وَنَسْجُدُ، وَلَكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ ، نَخْشَى عَذَابَكَ الْجَدَّ، وَنَرْجُو رَحْمَتَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكَافِرِينَ مُلْحَقٌ.
আল্লাহুম্মাগ ফিরলানা ওয়ালিল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত, ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত, ওয়া আল্লিফ বাইনা কুলুবিহিম, ওয়া আসলিহ জাতা বাইনিহিম, ওয়াংসুরহুম আলা আদুওয়িকা ওয়া আদুওয়িহিম, আল্লাহুম্মাল আন কাফারাতা আহলিল কিতাবিল্লা জিনা ইয়াসুদ্দুনা আন সাবিলিকা, ওয়া ইউকাজজিবুনা রুসুলাকা, ওয়া ইউকাতিলুনা আওলিয়াআকা, আল্লাহুম্মা খালিফ বাইনা কালিমাতিহিম, ওয়া জালজিল আকদামাহুম, ওয়া আনজিল বিহিম বাসাকাল্লাজি লা তারুদ্দুহু আনিল কাওমিল মুজরিমিন, আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা ওয়া নুসনি আলাইকা ওয়ালা নাকফুরুক ওয়া নাখলাউ ওয়া নাতরুকু মাই-ইয়াফজুরুকা। আল্লাহুম্মা ইইয়াকা নাবুদু ওয়া লাকা নুসাল্লি, ওয়া নাসজুদু, ওয়া লাকা নাসআ, ওয়া নাহফিদু, নাখশা আজাবাকালঝাদ্দা, ওয়া নারজু রাহমাতাক। ইন্না আজাবাকা বিল কাফিরিনা মুলহিক।’
হে আল্লাহ, ক্ষমা করুন আমাদের এবং মুমিন নারী-পুরুষদের, আর মুসলমান নারী-পুরুষদের। তাদের অন্তরসমূহ জুড়িয়ে দিন আর তাদের মাঝে মীমাংসা করে দিন। তাদের সাহায্য করুন আপনার ও তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে। হে আল্লাহ, অভিসম্পাত বর্ষণ করুন কাফের সম্প্রদায়ের ওপর, যারা আপনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং যারা অস্বীকার করে রাসুলদেরকে আর যুদ্ধবিগ্রহ করে ওলিদের সাথে। হে আল্লাহ, বিভেদ সৃষ্টি করে দিন তাদের ঐক্যের মাঝে এবং কম্পন সৃষ্টি করুন তাদের পদযুগলে আর নাজিল করুন এমন শাস্তি যা অপরাধী থেকে অপসারণ করা হয় না। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, হে আল্লাহ, আমরা আপনার নিকট সাহায্য এবং ক্ষমা চাই, সকল মঙ্গল আপনার দিকেই ন্যস্ত করি। আপনার অকৃতজ্ঞ হই না। যারা আপনার নাফরমানি করে আমরা তাদের পরিত্যাগ করে চলি। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, হে আল্লাহ, আমরা আপনারই দাসত্ব করি, আপনার জন্যে নামাজ পড়ি এবং আপনাকেই সিজদাহ করি। আমরা আপনার দিকে দৌড়াই ও এগিয়ে চলি। আপনার কঠিন আজাবকে ভয় করি এবং রহমতের আশা রাখি আর আপনার আজাব তো কাফেরদের জন্যই র্নিধারিত। (বায়হাকি: ২৯৬২)
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নাজুক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ফিলিস্তিন বা ভারতে মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের মতো মুসলিম উম্মাহর বিপদে সারা বিশ্বের মুসলমানদের কুনুতে নাজেলা পড়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এবং এটি মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের চরম সংকটে কুনুতে নাজেলার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।