ধর্ম ডেস্ক
১১ জুন ২০২২, ১১:২৬ এএম
ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম হজরত জায়েদ বিন হারিসা (রা.)। তিনিই একমাত্র সাহাবি, যার নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। প্রথম সারির ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যেও জায়েদ (রা.)-এর নাম অন্যতম। ‘খাদিজা (রা.) ও আলী (রা.)-এর পরেই জায়েদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারপর আবু বকর সিদ্দিক (রা.)।’ (সিরাতে ইবনে ইসহাক)
বাল্যকালে ইয়েমেন থেকে লুণ্ঠিত হয়েছিলেন জায়েদ। বিক্রি করার জন্য ওঠানো হয়েছিল ওকাজের বাজারে। তখন সদ্যই খাদিজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন মুহাম্মদ (স.)। খাদিজা (রা.)-এর ভাতিজা হাকিম বিন হিজাম জায়েদকে কিনে উপহার দিয়েছিলেন নবী-দম্পতিকে।
পরিবার বিয়োগে ব্যাথাতুর জায়েদ অল্প কিছুদিনেই নবী-দম্পতির ভালোবাসায় পেছনের সব কষ্ট ভুলে গেলেন। বহু বছর পর জায়েদের বাবা-মা একদিন জানতে পারলেন, ছেলেবেলায় হারিয়ে ফেলা তাদের সন্তান রয়েছে মক্কায়, মুহাম্মদ নামের এক নবীর ঘরে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। খবর পেয়েই জায়েদের বাবা ছুটে এলেন মক্কায়। তিনি তখনও প্রভাবশালী কোজায়া গোত্রের সর্দার। সম্পদের অভাব নেই। দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তিনি সন্তানকে ফেরত নিতে চান। তারা জায়েদকে বাড়ি নিতে উদ্যত হলেন। সবশুনে শান্ত কণ্ঠে নবীজি (স.) বললেন, জায়েদকে অধিকার দেওয়া হলো। সে যদি পরিবারের কাছে ফিরতে চায়, বিনিময় ছাড়াই সে যেতে পারে। আর যদি থাকতে চায়, তার সেই ইচ্ছাকেও মূল্যায়ন করা হবে।
নবীজির কথা শুনে আনন্দিত হলেন জায়েদের বাবা হারিসা। এত সহজ শর্ত! কিন্তু জায়েদ তখন শব্দহীন, ঝড়পূর্ব সমুদ্রের মতো গম্ভীর। চোখে পানি। ক্রীতদাস জায়েদ মাথা তুলে স্থির কণ্ঠে বললেন, নবীজির চেয়ে আমার কাছে বড় কিছু নেই, নবীজির কাছে থাকাকেই আমি পছন্দ করলাম। জায়েদ যখন তার সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছিলেন, তখন তার বাবা হতবাক। সন্তানের মুখে এ কেমন কথা শুনলেন তিনি! সেদিন জায়েদ (রা.) তার বাবাকে যতটা হতবাক করেছিলেন, পৃথিবীর কেউ হয়তো কোনো বাবাকেই অতটা হতবাক করেনি। আবেগ ও ভালোবাসার বাধ নবীজিরও ভেঙে গিয়েছিল সেদিন। তৎক্ষণাৎ জায়েদের হাত ধরে তিনি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন কাবার চত্বরে। তারপর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন— ওহে মক্কাবাসী, তোমরা শুনে রাখো, জায়েদ আজ থেকে মুক্ত। শুধু মুক্তই নয়, সে আমার সন্তান। সে আমার ওয়ারিস, আমি তার ওয়ারিস।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে জায়েদ নামটি উল্লেখ করে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন, যেখানে অন্য কোনো সাহাবির নাম উল্লেখ নেই। ‘..অতঃপর জায়েদ যখন তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের কোনো অসুবিধা না থাকে; যখন তারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করে। আর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়ে থাকে।’ (সুরা আহজাব: ৩৭)
কোরআনে জায়েদ বিন হারিসার নাম প্রসঙ্গে জানতে এখানে ক্লিক করুন
অকারণে কেউ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে না। মানুষকে আকৃষ্ট করার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল নবীজির। সেই ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর মহানুভবতা আর আখলাক দিয়ে। রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে খুব মর্যাদা দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ইরশাদ করেন, যখনই রাসুলুল্লাহ (স.) জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)-কে কোনো সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে পাঠিয়েছেন, তাঁকেই সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসির) নিশ্চয়ই জায়েদের (রা.)-এর মধ্যে নবীপ্রেমের অসাধারণ গুণ ছিল বলেই আল্লাহ তাআলাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলে দুনিয়া ধ্বংস হলেও জায়েদ নামটি কোরআনি নিরাপত্তার বলয়ে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে।
মুমিন হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত রাসুল (স.)-কে ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা হতে হবে বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি’ (বুখারি: ১৫)। তাই নবীপ্রেমিকেরা আজো জায়েদ বিন হারিসা (রা.)-এর মতো তাঁর প্রেমের আগুনে কীটপতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ উনি যে আল্লাহর পেয়ারা ও মহানুভব নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)।