ধর্ম ডেস্ক
২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম
আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও ভাগ্যলিপির ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব। মুমিনকে অবশ্যই এই বিশ্বাস রাখতে হয় যে—সবকিছু আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ও চূড়ান্ত। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার আগেই লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ।’ (সুরা হাদিদ: ২২)
এই মহাবিশ্বে ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা তাঁর পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব নির্ধারণ করে রাখাকে ভাগ্যলিপি আরবিতে তাকদির বলে। মানব-দানবসহ যত সৃষ্টি রয়েছে, সব কিছুর উত্থান-পতন, ভালো-মন্দ, উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি কোথায়, কোন সময়, কিভাবে ঘটবে—আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তাকদির দুই প্রকার—১. তাকদিরে মুবরাম (অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপি) ও ২. তাকদিরে মুআল্লাক (ঝুলন্ত ভাগ্যলিপি)। তাকদিরে মুআল্লাক বান্দার নেক আমল, দোয়া ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, দোয়া আল্লাহর ফয়সালাকে পরিবর্তন করাতে পারে। আর নেক আমল বয়সকে বৃদ্ধি করাতে পারে।’ (তিরমিজি: ২১৩৯)
তাকদিরে মুবরাম কখনোই পরিবর্তিত হয় না। ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টির ভাগ্যলিপি লিখে রেখেছেন, আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, তখন আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর।’ (মুসলিম: ২৬৫৩)
আরও পড়ুন: তাকদিরে লেখা আছে বলেই কি মানুষ গুনাহ করে?
মানুষের ভালো কাজ হোক বা খারাপ কাজ কোনোকিছুই তাকদিরের লিখন থেকে বাদ পড়েনি। এক কথায়, তাকদিরের বাইরে কোনো কিছু নেই। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসই তাকদির অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও।’ (মুসলিম, রিয়াদুস সালিহিন, পৃ-২৮২)
মনে রাখতে হবে, তাকদির অনুযায়ী সবকিছু হয়, তাকদিরের কারণে হয় না। অর্থাৎ ভবিষ্যতে মানুষ যা করবে, আল্লাহ তাআলা তা আগে থেকেই জানেন, ফলে তিনি তা আদিতেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আদিতে লিপিবদ্ধ করার কারণে মানুষ লেখা অনুযায়ী কর্ম করছে—বিষয়টি এমন নয়। বরং আমরা কখন কী করব, কী খাব, কোথায় কী ঘটবে—এগুলো আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকে জানেন। কারণ তিনি ইলমে গায়েবের অধিকারী।
তাই বান্দা গুনাহ করলে সেজন্য বান্দা নিজেই দায়ী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পাবে এবং সে আল্লাহ ছাড়া নিজের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আর নারী-পুরুষের মধ্য থেকে যারাই সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। অণু পরিমাণও তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা নিসা: ১২৩-১২৪)
আরও পড়ুন: যে ৬ বিশ্বাসের কারণে আপনি জান্নাতে যাবেন
ভাগ্য মূলত চারটি পর্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে তাকদির লিপিবদ্ধ হয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির আগে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি কলমকে বলেন, লেখো। অতঃপর কলম যা (বিদ্যমান) ছিল এবং কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সংঘটিত হবে তার সব কিছু লিখল।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৭০৫)
দ্বিতীয় পর্যায়ে মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ হয়। হাদিসে এসেছে, মাতৃগর্ভে মানবভ্রূণ মাংসপিণ্ডে পরিণত হওয়ার পর তার কাছে ফেরেশতা প্রেরিত হয়। ফেরেশতা তার ভেতর রুহ ফুঁকে দেন। তাঁকে চারটি বিষয় লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়: জীবিকা, বয়স, আমল ও তার সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য। (বুখারি: ৩২০৮)
ভাগ্যলিপি লিখনের তৃতীয় পর্যায় কদরের রাত। আল্লাহ বলেন, ‘এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ (সুরা দুখান: ৪)
চতুর্থ পর্যায় প্রতিদিন। অর্থাৎ প্রতিদিন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার জন্য যা দান করে থাকেন তাকে দৈনন্দিন ভাগ্যলিপি বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি প্রত্যহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে রত।’ (সুরা আর-রাহমান: ২৯)
আরও পড়ুন: পরকালে ১০ শ্রেণির মানুষের ভয়-চিন্তা নেই
তাকদিরের বাইরে কিছুই হয় না। কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন! যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছাড়া কিছুই আমাদের কখনোই স্পর্শ করবে না।’ (সুরা তাওবা: ৫১)
‘তাকদিরের প্রতি ঈমান’ মানে এ কথা বিশ্বাস করা যে একমাত্র মহান আল্লাহ ক্ষতির মালিক, উপকারকারী, দানকারী ও নিষিদ্ধকারী। সুতরাং বান্দার এ বিশ্বাস তার জন্য আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস, আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে গ্রহণ এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করাকে আবশ্যক করে। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ২০/৩১)
তাকদিরের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন কাজের কোনো সংঘাত নেই। হাদিসে রয়েছে, জনৈক সাহাবি আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যে ঝাড়ফুঁক করে থাকি, চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার করে থাকি কিংবা আত্মরক্ষার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কি তাকদিরের কোনো কিছুকে পরিবর্তন করতে পারে? প্রত্যুত্তরে রাসুল (স.) বলেন, তোমাদের এসব চেষ্টাও তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। (বায়হাকি)
অর্থাৎ প্রত্যেক কাজ তাকদিরের অন্তর্ভুক্ত। এখন আমরা তাকদির নিয়ে পড়ছি-সেটাও তাকদির তথা ভাগ্যলিপির অন্তর্ভুক্ত। তবে, তাকদির নিয়ে অযথা তর্কাতর্কি বর্জনীয়। হাদিস শরিফে তাকদির প্রসঙ্গে বিতর্ক করতে বারণ করা হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাকদিরের বিষয়ে কথা বলে, কেয়ামতের ময়দানে এ কারণে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর যে এ বিষয়ে আলোচনা করবে না, তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৮৪)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুল (স.) আমাদের কাছে এলেন, আমরা তখন তাকদির প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তখন রাসুল (স.) প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগে তাঁর চেহারা আনারের মতো রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, তোমরা কি এসব করতে আদিষ্ট হয়েছ? নাকি আমি এসবের জন্য প্রেরিত হয়েছি? এর আগের লোকজন এ বিষয়ে আলোচনা করে ধ্বংস হয়েছে, আমি তোমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। (তিরমিজি: ২১৩৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাকদিরের ওপর বিশ্বাস রাখার তাওফিক দান করুন। তাকদিরের ব্যাপারে অযথা বাক্যালাপ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।