images

ইসলাম

নবীজি দেখতে কেমন ছিলেন

ধর্ম ডেস্ক

০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২০ পিএম

মুসলমান মাত্রই প্রিয়নবীজি (স.)-এর মহব্বতের আশেক। তাঁকে মহব্বত করা ঈমানের শাশ্বত দাবি। তাই সকল আশেকে রাসুলের উচিত- তাদের চিন্তা-চেতনা, কাজ-কর্ম, বিচার-ফয়সালাসহ জীবনের সকল পর্যায়ে রাসুল (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ করা। নিজেকে সেই মতে প্রতিষ্ঠা করা। তবেই তাঁর প্রতি মহব্বত সার্থক হবে। অন্যথায় তা নিছক লৌকিকতা। রাসুল (স.)-এর আনুগত্যের ব্যাপারে আল-কোরআনে আল্লাহ তাআলা নিজেই বলে দিয়েছেন, يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ ‘হে  ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো...।’ (সূরা মুহাম্মদ: ৩৩)

রাসুল (স.)-এর প্রতি মহব্বতের মাপকাঠি সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সকল মানুষের চাইতে অধিক প্রিয় না হই।’ (বুখারি: ১৫; মুসলিম: ৬৯)

সেই রাসুল (স.)-এর দৈহিক গঠন সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে রয়েছে। রাসুল (স.)-এর চরিত্র, গুণাবলী ও দৈহিক আকৃতি-প্রকৃতির সুষমা বর্ণনা করা মহাসমুদ্রে মুক্তা খোঁজার মতো। তবুও এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে, দৈহিক গঠনে তিনি কেমন ছিলেন তা হাদিসের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

রাবিআ ইবনু আবু আবদুর রহমান (রহ.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, كان رسول الله - صلى الله عليه وسلم - ليس بالطويل البائن ، ولا بالقصير، ولا بالأبيض الأمهق ، ولا بالآدم ، ولا بالجعد القطط ، ولا بالسبط ‘রাসূল (স.) অতিরিক্ত লম্বাও ছিলেন না, আবার একেবারে খাটোও ছিলেন না। ধবধবে সাদাও ছিলেন না, তামাটে বর্ণেরও ছিলেন না। তাঁর চুলগুলো অধিক কোঁকড়ানোও ছিল না, আবার একেবারে সোজাও ছিল না। .... ।’ (সহিহ বুখারি: ৩৫৪৮; সহিহ মুসলিম: ২৩৪৭)

এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসুল (স.)-এর দেহ মোবারকের দীর্ঘতা ছিল মাধ্যম গড়নের, যা খাটোর তুলনায় লম্বার দিকে ঝোঁকা ছিল। তাঁর দৈহিক কাঠামোটা ছিল প্রশংসিত। তাঁর ত্বকের বৈশিষ্ট্য ছিল- সাদার ভেতরে লাল আভা শোভা পেত।

আরও পড়ুন: পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী ১৬ সেপ্টেম্বর

বারা ইবনুল আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم مَرْبُوعًا بَعِيْدَ مَا بَيْنَ الْمَنْكِبَيْنِ لَهُ شَعَرٌ يَبْلُغُ شَحْمَةَ أُذُنِهِ رَأَيْتُهُ فِيْ حُلَّةٍ حَمْرَاءَ لَمْ أَرَ شَيْئًا قَطُّ أَحْسَنَ ِ‘রাসুল (স.) মধ্যম আকৃতির ছিলেন। উভয় কাঁধের মধ্যস্থল প্রশস্ত ছিল। তাঁর মাথার চুল উভয় কানের লতি পর্যন্ত ছিল। আমি তাঁকে লাল ডোরাকাটা জোড়া চাদর পরা অবস্থায় দেখেছি। আমি তাঁর চেয়ে অধিক সুন্দর আর কোনোকিছু দেখিনি।’ (সহিহ বুখাবি: ৩৫৫১; সহিহ মুসলিম: ২৩৩৭)

এই হাদিসমতে, তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যস্থল প্রশস্ত ছিল। এর দ্বারা বোঝা যায়, তার সিনা মোবারকও প্রশস্ত ছিল, যা পরিমিত অবস্থার বেশি ছিল না। যা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। 

আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِالطَّوِيلِ وَلاَ بِالْقَصِيرِ شَثْنَ الْكَفَّيْنِ وَالْقَدَمَيْنِ ضَخْمَ الرَّأْسِ ضَخْمَ الْكَرَادِيسِ طَوِيلَ الْمَسْرُبَةِ إِذَا مَشَى تَكَفَّأَ تَكَفُّؤًا كَأَنَّمَا انْحَطَّ مِنْ صَبَبٍ لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ ‘রাসুলুল্লাহ (স.) না অতি লম্বা ছিলেন আর না বেঁটে ছিলেন। হাত-পায়ের তালু ও আঙুলসমূহ মাংসল ছিল। মাথা কিছুটা বড় ছিল। হাড়ের গ্রন্থিসমূহ মোটা ও মজবুত ছিল। তাঁর বুক হতে নাভি পর্যন্ত ফুরফুরে পশমের একটি চিকন রেখা প্রলম্বিত ছিল। চলার সময় সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে চলতেন, যেন তিনি ঢালবিশিষ্ট জায়গা থেকে হেঁটে চলছেন। আমি তার পূর্বে কিংবা পরে আর কাউকে তাঁর মতো দেখিনি।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৩৭)

তাঁর হাত-পায়ের তালু ও আঙুলসমূহ মোটা ও পরিমিত লম্বা ছিল। আর তাঁর আঙুলগুলো ছোটো ছিল না। অঙ্গসমূহের এরকম গঠন প্রকৃতি পুরুষের ক্ষেত্রে অতি প্রশংসনীয়। নবীজি যখন জিহাদ বা ঘরের কোনো কাজ নিজ হাতে করতেন, তখন তাঁর হাতের তালু অমসৃণ হতো। আবার যখন কাজ থেকে বিরত থাকতেন, মসৃণতা ফিরে আসত। যা ছিল নবীজির সৃষ্টিগত সৌন্দর্য।

আরও পড়ুন: নবীজির জীবনী কেন পড়বেন

সিমাক ইবনু হারব (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি জাবির ইবনু সামুরা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, عَنْ شُعْبَةُ، عَنْ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ، قَالَ سَمِعْتُ جَابِرَ بْنَ سَمُرَةَ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ضَلِيعَ الْفَمِ أَشْكَلَ الْعَيْنِ مَنْهُوسَ الْعَقِبَيْنِ ‏.‏ قَالَ قُلْتُ لِسِمَاكٍ مَا ضَلِيعُ الْفَمِ قَالَ عَظِيمُ الْفَمِ ‏.‏ قَالَ قُلْتُ مَا أَشْكَلُ الْعَيْنِ قَالَ طَوِيلُ شَقِّ الْعَيْنِ ‏.‏ قَالَ قُلْتُ مَا مَنْهُوسُ الْعَقِبِ قَالَ قَلِيلُ لَحْمِ الْعَقِبِ ‏.‏ ‘রাসুল (স.) প্রশস্ত চেহারার অধিকারী ছিলেন। চোখের শুভ্রতার মাঝে কিছুটা লালিমা ছিল। তিনি সুষম গোড়ালিবিশিষ্ট আকৃতির অধিকারী ছিলেন। শুরা (রহ.) বলেন, আমি সিমাক (রহ.)-কে জিজ্ঞাস করলাম, দালিউল ফাম কী? তিনি বললেন, প্রশস্ত চেহারা। আমি বললাম, আশকালুল আইন কী? তিনি বললেন, ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট। আমি বললাম, মানহুসুল আকাব কী? তিনি বললেন, গোড়ালিতে মাংস কম হওয়া’। (সহিহ মুসলিম: ২৩৩৯)
   
জাবির ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي لَيْلَةٍ إِضْحِيَانٍ فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَإِلَى الْقَمَرِ وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ حَمْرَاءُ فَإِذَا هُوَ عِنْدِي أَحْسَنُ مِنَ الْقَمَرِ ‘ আমি রাসুল (স.)-এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তাঁর পরনে ছিল এক জোড়া লাল রংয়ের পোশাক। আমি রাসুল (স.) ও চাঁদের দিকে তাকাতে লাগলাম। আমার চোখে রাসুল (স.) চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর ছিলেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ২৮১১)

সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি সামুরা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, وَجْهُهُ مِثْلُ السَّيْفِ قَالَ لاَ بَلْ كَانَ مِثْلَ الشَّمْسِ وَالْقَمَرِ وَكَانَ مُسْتَدِيرًا ‘ নবীজির চেহারা কি তরবারির মতো ছিল? তিনি বললেন, না, বরং চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় ছিল এবং তা গোলাকার ছিল।’ (সহিহ মুসলিম: ২৩৪৪)

আরও পড়ুন: নবীজির আদর্শ হোক জীবনের পাথেয়

সূর্যের সাথে উপমা পেশ করার উদ্দেশ্য হলো- তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা বর্ণনা করা। আর চন্দ্রের সাথে তুলনা করার তাৎপর্য হলো লাবণ্যময়তা তুলে ধরা। এই উভয় উপমায় তাঁর অপার সৌন্দর্য ও গোলাকৃতির বিষয়টির ইঙ্গিত রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (স.)-এর চেয়ে অধিক সুন্দর কোনোকিছু দেখিনি। যেন সূর্য তাঁর চেহারায় বিচরণ করছে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৮৬০৪)

রুবাইয়্যা বিনতে মুআওয়িজ (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে- তিনি বলেন, ‘হে প্রিয় বৎস! যদি তুমি তাঁকে দেখতে- তাহলে বলতে, সূর্য উদিত হয়েছে।’ তিনি মোটাও ছিলেন না, আবার চিকনও নন। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘যেহেতু সৌন্দর্য অন্তর আকৃষ্টের কারণ এবং মর্যাদা দানের কারণ হয়, এজন্য আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবীকেই সুন্দর আকৃতি, সুন্দর চেহারা, শ্রেষ্ঠ বংশ, উত্তম চরিত্র ও মায়াবী কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রেরণ করেছেন।’ 

আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, لَمَّا قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ انْجَفَلَ النَّاسُ إِلَيْهِ وَقِيلَ قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَجِئْتُ فِي النَّاسِ لأَنْظُرَ إِلَيْهِ فَلَمَّا اسْتَبَنْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَرَفْتُ أَنَّ وَجْهَهُ لَيْسَ بِوَجْهِ كَذَّابٍ وَكَانَ أَوَّلَ شَيْءٍ تَكَلَّمَ بِهِ أَنْ قَالَ ‏ "‏ أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلاَمَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِسَلاَمٍ ‘রাসুল (স.) যখন মদিনায় এসে পৌঁছলেন, লোকজন তাঁকে দেখার জন্য দ্রুত তাঁর দিকে ছুটতে লাগল এবং বলাবলি করতে লাগলো- রাসুলুল্লাহ (স.) এসেছেন। অতএব আমিও তাঁকে দেখার জন্য লোকদের সাথে উপস্থিত হলাম। আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চেহারা মুবারকের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম যে, এই চেহারা কোনো মিথ্যুকের চেহারা নয়। তখন তিনি সর্বপ্রথম যে কথা বললেন, তা হলো- হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান করো এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় (তাহাজ্জুদ) নামাজ আদায় করো। তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা অনায়াসে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে তিরমিজি: ২৪৮৫)

লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক