ধর্ম ডেস্ক
৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:১৬ পিএম
টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুরু হতে যাচ্ছে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্বের ইজতেমায় মাওলানা জুবায়ের আহমদ পক্ষের অনুসারীরা অংশ নেবেন। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবেন ওয়াসিফুল ইসলাম পক্ষের অনুসারীরা।
৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণত ডিসেম্বরে কিংবা জানুয়ারি মাসে এই জমায়েত বাংলাদেশে হয়ে আসছে। তবে এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে তা কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় জমায়েত। লাখ লাখ মানুষ এই জমায়েতে অংশ নেন, যাদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
তাবলিগ জামাতের শুরু যখন
তাবলিগ জামাতের গোড়াপত্তন হয় ভারতে। উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের সূচনা হয়। ১৯২৬ সালে এই জামাত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এই ধারার প্রতিষ্ঠাতা হলেন- ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ)। তিনি ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের মোজাফফরনগর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠার পরপরই উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমানদের আস্থা কুড়াতে সক্ষম হয় তাবলিগ জামাত। ফলে ভারতবর্ষের তৎকালীন বাংলা অঞ্চলেও এই দাওয়াতি মিশন ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: তাবলিগ জামাতের ছয় মূলনীতি
তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠার কারণ
মাওলানা ইলিয়াস তখন উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর মাজাহেরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন এবং সাহারানপুরের বাংলাওয়ালি মসজিদে ওয়াজ-নসিহত করতেন। সেখানে পাশের মেওয়াত নামক গ্রাম থেকে লোকজন আসতেন। তাদের অনুরোধে তিনি মেওয়াত যান এবং সেখানে কয়েক শ মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তিনি অনুভব করলেন- মক্তবগুলোতে সীমিতসংখ্যক মুসলমান ইসলামের শিক্ষা নিচ্ছে, এর বাইরে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ধর্মের মৌলিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তাদের জন্য তিনি ইসলাম প্রচারের এমন এক পদ্ধতির কথা ভেবেছেন, যার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমানের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে যাবে এবং তারা নিজেদের শুদ্ধ করতে পারবে। এমন চিন্তা থেকেই তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর পরিশ্রম করে মূলত তাবলিগ জামাতকে বিশ্বব্যাপী সফল দাওয়াতি মিশন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুমান অনুসারে, ১৫০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৮ কোটি তাবলিগ জামাতের অনুসারী রয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করেন। মাওলানা ইলিয়াসের এই দাওয়াতি মিশন সম্পর্কে ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলি নদভি বলেন, ‘দরবেশ আলেম ইলিয়াস শুধু মেওয়াতেই নন, পুরো বিশ্বে এক শুদ্ধবাদী বিপ্লবের সূচনা করেছেন, যার নজির ইসলামের ইতিহাসে বিরল।’ (বায়োগ্রাফি অব মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস)
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আরেকটি তথ্য পাওয়া যায়। সেটি হলো- তাবলিগ জামাত শুরু হয়েছিল একটা আন্দোলন হিসেবে। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে যারা অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছিল তাদেরকে আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তখন দেওবন্দ কেন্দ্রিক মুসলমানেরা চিন্তা করলেন মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরো সচেতন করে তুলতে হবে। এটাকে আন্দোলন বলা হয় এই অর্থে যখন একটা গোষ্ঠী অনেক লোক নিয়ে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত করে তখন সেটা আন্দোলনের রূপ নেয়। 
আরও পড়ুন: ‘বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে দু’পক্ষের সমঝোতা হয়েছে’
বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে শুরু যেভাবে
বাংলাদেশে মাওলানা আবদুল আজিজের তত্ত্বাবধানে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে ১৯৪৬ সালে তাবলিগের প্রথম ইজতেমা আয়োজিত হয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তাবলিগ জামাতের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমা আয়োজিত হয়। তখন থেকে অন্যান্য দেশ থেকেও মুসল্লিরা ইজতেমায় যোগ দেওয়া শুরু করেন। এরপর প্রতি বছর তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ১৬০ একরের বিশাল মাঠে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
তবে, বাংলাদেশে ইজতেমার কার্যক্রম আরও আগে শুরু হয়। বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর দিয়ে হজে যাওয়ার জন্য মানুষ সেখানকার হজ ক্যাম্পে জড়ো হতেন, আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আঞ্চলিক ইজতেমা। সময়টি ছিল ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে। বাংলাদেশে প্রথম তাবলিগের জামাত নিয়ে আসেন প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ করছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর মোহাম্মদ ইউসুফ দুই দেশেই জামাত পাঠানো শুরু করলেন ইজতেমা আয়োজনের জন্য। তবে তখন ছোট আকারে ইজতেমা হত।
পরে ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে তাবলিগের সম্মেলন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ‘১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার রমনা পার্কের কাছে কাকরাইল মসজিদ, যেটা সে সময় মালওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত ছিল—সেখানে এই সম্মেলনটা হয়। এরপরে সম্মেলন হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে।’
আরও পড়ুন: ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের নির্দেশনা
১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি জামাত আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। এরপর তিনি তাবলিগ জামাতের শুরা কমিটির উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার পর মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন বলে জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস।
তিনি বলেন, ‘তাবলিগের জমায়েতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। পরের বছর ঠিক করা হয় ইজতেমা হবে টঙ্গীর তুরাগ নদীর কাছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান টঙ্গীতেই ১৬০ একর জমি নির্ধারণ করে দেন ইজতেমার জন্য।’

বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে আয়োজন করার কারণ
এ ব্যাপারে বিশ্লেষকদের বিভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, এটি লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। আবার কেউ বলেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ তাই বাংলাদেশে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আবদুর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ব ইজতেমা মূলত সুন্নি মুসলমানদের সমাবেশ। ভারত ও পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা বাধে, কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। তাই বাংলাদেশকেই ‘বিশ্ব ইজতেমা’র আয়োজক দেশ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
আরও পড়ুন: ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গী স্টেশনে বিরতি দেবে সব ট্রেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষক ও লেখক একেএম খাদেমুল হক বলেন, দুটো কারণে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে হয়েছে। ‘একটি বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। আরেকটি তাবলিগ জামাতের যে আন্দোলন সেটা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক। যদিও ভারতে এর শুরু কিন্তু ভারত মুসলিম-প্রধান দেশ না হওয়ার কারণে অনেক দেশের মুসলিমরা সেদেশে যেতে কমফোর্ট ফিল করেননি। আবার পাকিস্তানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে।’
বিশ্ব ইজতেমা নাম যেভাবে হলো
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগের দেওয়া নাম নয়, বরং তাবলিগের লোকজন এটাকে বার্ষিক সম্মেলন বলতেন। যখন বিদেশ থেকে লোক আসা শুরু করল, তখন গ্রামের লোক এটাকে বিশ্ব ইজতেমা বলা শুরু করল। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নাম নিয়ে তাবলিগ জামাতের মধ্যেই শুরুতে বিতর্ক ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমা নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।
২০১১ সালের আগে একপর্বে তিনদিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হত। ব্যাপক উপস্থিতি, জনদুর্ভোগ ইত্যাদি চিন্তা করে আইন-শৃ্ঙ্খলা ও নিরাপত্তার তাগিদে তাবলিগের শুরা সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিন দিন করে দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বিরতি দিয়ে ২০২৩ সালে প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি, শেষ হয়েছে ১৫ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে ২০ জানুয়ারি, যা ২২ জানুয়ারি শেষ হয়।