ধর্ম ডেস্ক
০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৬ পিএম
রসিকতা মানুষের আচার-ব্যবহারেরই এক অনুষঙ্গ। একটু রঙ্গ-রসিকতা আলোচনায় সজিবতা আনে। গুমোট পরিবেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। অনেক বড় সমস্যারও সমাধান হয়ে যায় রসিকতার ছলে। সুতরাং ইসলাম রসিকতার বিপক্ষে নয়। তবে রসিকতা করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া এবং অসৎ উদ্দেশ্যে রসিকতা করা ইসলামি শরিয়তে নাজায়েজ।
প্রিয়নবীজির রসিকতার যত ঘটনা আমরা দেখতে পাই, সবগুলোই ছিল বাস্তবসম্মত, সত্য, সুন্দর। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক ব্যক্তি এসে নবী কারিম (স.)-এর কাছে একটা বাহনজন্তু চাইল। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ, আমরা তোমাকে একটা উটনীর বাচ্চা দেব। লোকটি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, আরে উটেরা সব উটনীদেরই বাচ্চা নয় কি? (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯৮; তিরমিজি: ১৯৯১)
আরও পড়ুন: নবীজির জীবনী পড়ার উপকারিতা
নবীজির এরকম অনেক রসিকতার ঘটনা সীরাতে রয়েছে। প্রতিটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যেমন একবার তিনি হজরত আনাস (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘ওহে দু’কানওয়ালা’! (তিরমিজি: ১৯৯২) কান তো মানুষের দুটিই হয়। তা সত্ত্বেও যখন কাউকে মজা করে দু’কানওয়ালা বলা হয়, প্রথমে সে চমকে উঠবে। কিন্তু রসবোধওয়ালা মানুষ হলে বুঝতে পারবে- এর দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রশংসাই করা হচ্ছে যে, তুমি নিখুঁত শোন এবং বুঝতেও পারো বেশ। সত্য কথার কি অপূর্ব রসিকতা!
নবীজির শিক্ষা হলো- তুমি রঙ্গ-রসিকতা করো ঠিক আছে, কিন্তু সাবধান, মাত্রা ছাড়িয়ে যেও না। কিন্তু রসিকতার যথাযথ প্রয়োগ আমরা অনেকেই জানি না। কখনও সীমালংঘন করে ফেলি। এমনও দেখা যায় যে, রসিকতার পেছনে কাজ করে অসৎ উদ্দেশ্য। এতে পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, আন্তরিকতা নষ্ট হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবাই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- যাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে রসিকতা করা হচ্ছে সে কষ্ট পায়। ইসলামে কাউকে কষ্ট দেওয়া জঘন্য গুনাহ। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, لا تمار أخاك ولا تمازحه ‘তোমার ভাইয়ের সাথে বাক-বিতণ্ডা করো না এবং তার সাথে পরিহাস করো না’। এ নিষেধাজ্ঞা এজন্যই করেছেন যে, সাধারণত আমাদের রসিকতা কখনও হয়ে যায় লাগামহীন। হয় তাতে মিথ্যার আশ্রয় নিই, নয়ত কাউকে আহত করার উদ্দেশ্য থাকে। এসব করিরা গুনাহ।
দুর্ভাগ্যবশত এ জাতীয় ঠাট্টা-রসিকতা অনেকটা সামাজিক কালচারে পরিণত হয়েছে। সভা-সমিতিতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ করে যে যত বেশি তা উদ্গীরণ করতে পারে, সুবক্তা হিসেবে সে ততটাই সমাদৃত হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। এ ধরণের ব্যঙ্গ-পরিহাসে মজা পাওয়া একরকম হীনতা বা মানসিক বিকৃতি—সে কথা আমরা ভুলে গেছি। এই মানসিক বিকৃতি সমাজের সর্বস্তরে ক্রমবিস্তার লাভ করছে আর এর ফলে বাড়ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস, আত্মকলহ ও নানারকম অশান্তি।
এর থেকে নিস্তার লাভ করতে হলে হাস্য-পরিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! পুরুষরা যেন অপর পুরুষদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে, তারা) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরাও যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যে নারীদেরকে উপহাস করা হচ্ছে) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে কটাক্ষ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। (এসব ফাসেকি কাজ। আর) ঈমানের পর ফাসেকি নামযুক্ত হওয়া বড় খারাপ কথা। যারা এসব থেকে বিরত না হবে তারাই জালেম’। (সুরা হুজুরাত : ১১)
আরেকটি বিরক্তিকর রসিকতা হলো একই কথা বারবার বলা। এটি নির্বুদ্ধিতাবশত করা হয় অথবা উত্যক্ত করার ইচ্ছায় করা হয়। সবাই জানে যে, একই কথার বারবার উচ্চারণ কারোরই ভালো লাগে না। ভালো কথাও বারবার বললে অসহ্য প্যাচাল হয়ে যায়। তাই এটি হলো রসিকতার চরম বাড়াবাড়ি ও অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এ থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারো মধ্যে এ ধরণের ভুল দেখলে জ্ঞানীদের কর্তব্য হলো- পরিণামের কথা স্মরণ করিয়ে তার বোধোদয়ে সহযোগিতা করা।
আরও পড়ুন: উম্মতের মুক্তির জন্য নবীজির কান্না
ইদানীং লক্ষ করা যায়, গুরুজনদের সাথে, এমনকি বাবা ও শিক্ষকের সংগেও এমন-এমন রসিকতা করা হয়, যা শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে না। এমনটা অবশ্যই পরিহার্য। ছোটরা কেমনে রসিকতা করবে বা বড়দের রসিকতা কেমন হবে—সবকিছুর সুন্দর উপমা হাদিসে রয়েছে। ছোটদের একটি শীলিত রসিকতার উদাহরণ হিসেবে এক সাহাবির ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একবার প্রিয়নবী (স.) একটি তাঁবুর ভেতর অবস্থান করছিলেন। সেই সাহাবি এসে তাঁর সংগে দেখা করতে চাইলেন। নবীজি তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন, কিন্তু তাঁবুটি ছিল বেশ ছোট। সাহাবি রসিকতা করে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পুরো শরীরটাই প্রবেশ করাব, না আংশিক? প্রিয়নবী (স.) বললেন, পুরোটাই। (সুনানে আবু দাউদ: ৫০০০)
মোটকথা রসিকতাকে সবরকম ক্ষতি থেকে রক্ষা করে সুফলদায়ী করে তোলার জন্য কর্তব্য স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে ভাষা, পরিমাণ, বিষয়বস্তু, ধরণ-ধারণ ইত্যাদিতে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে হবে। এককথায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। হজরত সাঈদ ইবনুল আস (রা.) নিজ পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, বাছা! রসিকতায় পরিমিতিবোধের পরিচয় দিও। এতে বাড়াবাড়ি ভাবমূর্তি নষ্ট করে ও মূর্খদের অন্তরে ধৃষ্টতার জন্ম দেয়। আবার এর অভাবে প্রিয়জনেরা তোমার থেকে দূরে সরে যাবে এবং বন্ধু-বান্ধবরা তোমাকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করবে। (আদাবুদ দুনয়া ওয়াদ-দ্বিন, পৃ-২৭১)