images

ইসলাম

দলবদ্ধ জিকির কি বিদআত?

ধর্ম ডেস্ক

২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:২১ পিএম

ইসলামে জিকিরের মজলিস কায়েম করা বা লোকজন একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকির করা জায়েজ। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে এমন জিকিরের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। হাদিসে এর ফজিলতও বিদ্যমান রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ (রা.) দুজনেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন- যে জামাত আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকে, ফেরেশতারা উহাকে চারদিক থেকে ঘিরে নেন। আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়। তাদের ওপর সকিনা নাজিল হয়। আর আল্লাহ তাআলা নিজ মজলিসে (গর্ব করে) তাদের আলোচনা করেন। (সহিহ মুসলিম: ২৭০০; মুসনাদে আহমদ: ১১৮৭৫)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ঘোষণা করেন, আমি সেরকমই, বান্দা যেরকম আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জনসমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। (সহিহ বুখারি: ৭৪০৫)

সুতরাং জিকিরের হালকা কায়েম করে স্বতন্ত্র স্বরে জিকির করাকে বিদআত বলা যাবে না। আর যদি প্রশিক্ষণ হিসেবে সমস্বরেও করে তবুও তা বিদআত হবে না। কারণ তা প্রশিক্ষণ। কোনো হক্কানি পির সাহেব প্রশিক্ষণ হিসেবে এভাবে জিকির করার পরামর্শ দিলে তাতে সমস্যা নেই। তা বিদআতের সংজ্ঞায় পড়বে না।

তবে সকলে একসঙ্গে সমস্বরে সুরের সাথে সুর মিলিয়ে কোরাস কণ্ঠে জিকিরের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ পদ্ধতির জিকিরকে সুন্নত বলার সুযোগ নেই। (দ্রষ্টব্য: আল মুজামুল কাবির লিততিবরানি: ৮৬৩০; মুসান্নাফ আব্দুর রাজজাক: ৫৪০৯; দারেমি: ১/২৮৬, নম্বর: ২১০)

আরও পড়ুন: যেভাবে জিকির করবেন

জিকির শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। যেমন—আল্লাহর স্মরণ, জিহবার জিকির, উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ, আনুগত্য, মর্যাদা, গৌরব, সংবাদ, শরিয়ত, লাউহে মাহফুজ ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনেরও এক নাম জিকির। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা বরকতময় জিকির (কোরআন)। আমি তা অবতীর্ণ করেছি। তবু কি তোমরা তা অস্বীকার করবে?’ (সুরা আম্বিয়া: ৫০)

নামাজকেও জিকির নামে অভিহিত করেছেন আল্লাহ তাআলা। নবী দাউদ (আ.)-এর ঘটনা প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, ‘সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের জিকির (নামাজ) থেকে বিমুখ হয়ে ঐশ্বর্যপ্রীতিতে মগ্ন হয়ে গেছি। এদিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে।’ (সুরা সাদ: ৩২)

অতএব, জিকির মানেই কোরাস কণ্ঠে সুর মিলিয়ে নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ নয়। মুহাদ্দিসরা বলেন, আল্লাহর যেকোনো ধরনের আনুগত্য ও ইবাদত, আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলির উচ্চারণ, কোরআন তেলাওয়াত ও ধর্মীয় আলোচনা—সবই জিকির তথা আল্লাহর স্মরণের অন্তর্ভুক্ত। সাধক আলেমরা তাঁদের অনুসারীদের অবস্থা বিবেচনায় বিশেষ জিকির ও তাসবিহ পাঠের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শরিয়ত সমর্থন করলে এসবকিছুই জিকির হিসেবে গণ্য। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দ্বীনি সব বিষয়ই জিকিরের আওতাভুক্ত। 

জিকিরের উদ্দেশ্যে লোকজন একত্রিত হলে আল্লাহ তাআলার কাছে তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা তাদের গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি তাদের গুনাহগুলোকে সওয়াবে পরিণত করে দেওয়া হয় বলেও নবীজির ঘোষণা রয়েছে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, যেসব লোক আল্লাহর জিকিরের জন্য একত্রিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তখন আসমান হতে এক ফেরেশতা ঘোষণা করেন যে, তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে এবং তোমাদের গুনাহগুলোকে নেকিতে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ: ১২৪৫৩, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১৬৭৬৪)

আরও পড়ুন: মজলিসে জিকিরের ফজিলত

আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কিছু লোকের হাশর এমনভাবে করাবেন যে, তাদের চেহারায় নুর চমকাতে থাকবে, তারা মোতির মিম্বরে বসা থাকবে। অন্যান্য লোক তাদের প্রতি ঈর্ষা করতে থাকবে। তারা নবীও হবেন না, শহীদও হবেন না। কেউ বলল যে, হে আল্লাহর রাসুল, তাদের অবস্থা বলে দিন, যেন আমরা তাদের চিনতে পারি। নবীজি (স.) বললেন, তারা ওই সমস্ত লোক যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং বিভিন্ন খান্দান থেকে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন হতো। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১৬৭৭০)

আব্দুর রহমান বিন সাহল বিন হুনাইফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) তার এক ঘরে থাকাকালীন সময়ে সুরা কাহাফের ২৮ নম্বর আয়াত (অর্থ:) ‘আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখো তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে..’ নাজিল হয়। তখন তিনি তাদের অনুসন্ধানে বের হলেন। তখন এক জামাতকে পেলেন যারা আল্লাহর জিকিরে মশগুল। যাদের মাঝে কিছু লোকের মাথার চুল এলোমলো, শরীরের চামড়া শুকনো এবং একটি মাত্র কাপড় পরিহিত। যখন নবীজি তাদের দেখলেন তখন তাদের সাথে বসে গেলেন। তারপর বললেন, আল্লাহর শুকরিয়া যিনি আমার উম্মতের মাঝে এমন লোক সৃষ্টি করেছেন, স্বয়ং আমাকে যাদের সাথে বসার হুকুম করেছেন। (মারিফাতুস সাহাবা, লিআবি নুআঈম, হাদিস: ৪৬১৭, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১০৯৯৮, তাফসিরে তাবারি: ৬/১৮, তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/১৩৯, ফাতহুল কাদির, শাওকানিকৃত: ৩/৩৩৬) ইমাম হায়ছামি হাদিসটির ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন- رِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ অর্থাৎ এ হাদিসের রাবিগণ বুখারির রাবি। 

আরও পড়ুন: আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ১৬ আমল

জিকিরের তিনটি পদ্ধতি আছে—১. যে জিকির কল্পনা ও চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাতে জিহ্বার সামান্য স্পন্দনও হয় না। ২. যে জিকিরে আত্মার কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাও নড়বে। তবে আওয়াজ অন্যরা শুনতে পাবে না। ৩. অন্তরে উদ্দিষ্ট সত্তার উপস্থিতি ও ধ্যান করার পাশাপাশি জিহ্বার স্পন্দনও হবে এবং সেই সঙ্গে শব্দও বের হবে। 

সরব ও নীরব জিকিরের মধ্যে কোনটি উত্তম, তার ফায়সালা অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে বলে মনে করেন আলেমরা। সুরা আরাফের ৫৫ ও ২০৫ নম্বর আয়াত দ্বারা ‘আস্তে জিকির’ উত্তম প্রমাণিত হয়। আবার সাহাবায়ে কেরাম ও পূর্ববর্তীদের আলেমদের থেকে উচ্চৈঃস্বরে জিকিরেরও প্রমাণ রয়েছে। মূল বিষয়টা হচ্ছে- ইসলাম যেখানে যেভাবে জিকির করতে বলেছে, সেখানে সেভাবে জিকির করাই উত্তম। যেমন—আজান, ইকামত, কোরআন তেলাওয়াত, নামাজের তাকবির, তাকবিরে তাশরিক ইত্যাদি উচ্চৈঃস্বরে বলা উত্তম। আবার ক্ষেত্রবিশেষে কিছু জিকির আস্তে করা উত্তম। যেমন-খায়বর যুদ্ধে সাহাবিদের তাকবির ধ্বনি উচ্চৈঃস্বরে হয়ে গেলে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হে মানুষ, নরম হও, বিনম্র আওয়াজে আল্লাহকে ডাকো...তোমরা বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছ না।’ (সহিহ মুসলিম) হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘আগের মনীষীরা বেশির ভাগ সময় আল্লাহর জিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন; কিন্তু কেউ তাঁদের আওয়াজ শুনতে পেত না।’

মূলত জিকির বা আল্লাহর স্মরণ মুসলমানদের জন্য শক্তির একটি উৎস। ‘হাদিসে কুদসি’-তে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি আমার বান্দার সঙ্গে ততক্ষণ থাকি যতক্ষণ সে আমাকে স্মরণ করে’। (সহিহ বুখারি: ৬৮৫৬) 

কোরআন-হাদিসে সবসময় জিকির করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। মহানবী (স.) বলেন, ‘জান্নাতবাসীদের মনে কোনো-কারণেই কোনো দুঃখ থাকবে না; দুঃখ শুধু একটা কারণেই হবে, তা হলো পার্থিব জীবনের যে-মুহূর্তগুলো তারা মহামহিমান্বিত আল্লাহ পাকের স্মরণ থেকে উদাসীন ছিল।’ (তবারানি: ২০/৯৪) আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেক বিষয়ে সহিহ বুঝ দান করুন। শরিয়তের নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।