images

রাজনীতি

ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৪৩ পিএম

কমিটি বাণিজ্য ও অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের অভিযোগ পাওয়া গেছে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের বিরুদ্ধে। এছাড়া বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের সিনিয়র নেতাদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং ছাত্রদলকে বরিশাল সমিতিতে পরিণত করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রদলের শীর্ষ এই দুই নেতা।

এক সময় বিএনপির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখভাগে অংশ নিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিল ছাত্রদল। বিশেষত নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রদলের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই গৌরব হারাতে বসেছে সংগঠনটি। দীর্ঘদিন কমিটি পুনর্গঠন ও হালনাগাদ না করা এবং অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং-কোন্দলের কারণে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারছে না ছাত্রদল।

গত বছরের ১৭ এপ্রিল সংগঠনের সাংগঠনিক অভিভাবক ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সুপার ফাইভ কমিটি ঘোষণা করেন। এতে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি, সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীতে তাদের নেতৃত্বে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়।

>> আরও পড়ুন: যে ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে ছাত্রদল-ছাত্রলীগ

ছাত্রদল-সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ও পশ্চিম ছাত্রদল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিতে এসএসসি ২০০১ সালকে মানদণ্ড ধরা হলেও কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয় এসএসসি ২০০৩ সালকে মানদণ্ড ধরে। অন্যদিকে আর্থিক লেনদেনকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে বিবাহিত, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিজস্ব বলয়ের বিবাহিত, অপহরণ ও মোটরসাইকেল ছিনতাই মামলার আসামি ও ব্যবসায়ীরা কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। প্রাধান্য পেয়েছেন বরিশাল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতাকর্মীরা। ৩০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৪৫ জনের বেশি বিবাহিত। ছাত্রজীবন শেষ করে অনেকেই চাকরি করছেন। অছাত্র, বিবাহিত, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ অসংখ্য অসামঞ্জস্য নিয়েই গঠিত হয়েছে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ৩০২ জনের মধ্যে শতাধিক বৃহত্তর বরিশালের। শুধু তাই নয়, কমিটিতে পদ পাওয়া এমন ৫৭ জনের একটি তালিকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বরাবর প্রেরণ করেছেন পদবঞ্চিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা। তখন প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩৩ জনের পদ সাময়িকভাবে স্থগিতও করা হয়।

>> আরও পড়ুন: ছাত্রদল নেতা নয়ন হত্যা, দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক বিএনপির

ঢাবি ক্যাম্পাসে নেই কার্যক্রম: জানা গেছে, ছাত্ররাজনীতির আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কার্যক্রম নেই। সংগঠনের বিগত কমিটির নেতারা ঢাবিতে রাজনীতির সহাবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বর্তমান কমিটি। ঢাবি থেকে বিতাড়িত হওয়ার নেপথ্যে সাধারণ সম্পাদক জুয়েলের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা আদনান আলম বাবু, তিনি সাইফ মাহমুদ জুয়েল গ্রুপের বড় ভাই। একই সঙ্গে তিনি ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের আপন মামাতো ভাই। তিনি একই সঙ্গে জয়কে দিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে সুবিধা নিয়েছেন, তেমনি নিজ সংগঠনের এবং নিজ গ্রুপের ছোট ভাই জুয়েলের কাছে ছাত্রদলের তদবির করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ২৪ মে ঢাবির টিএসসিতে মিছিল-পরবর্তী সভায় শেখ হাসিনাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বক্তব্য দেন জুয়েল। তার আগের দিন আদনান বাবুর মধ্যস্থতায় ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে একটি কালো রঙের গাড়িতে বসে আল নাহিয়ান খান জয় ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল আধা ঘণ্টার বেশি সময় আলাপ করেন। পরদিন ২৪ মে জুয়েল ক্যাম্পাসে বক্তব্য দেওয়ার পর প্রথমে জয়ের অনুসারীরাই ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। ওই ঘটনা যে জয়-জুয়েলের পরিকল্পিত তা আরও স্পষ্ট হয় যখন জুয়েল ক্যাম্পাসে নিজে হাতে বাঁশ নিয়ে ছাত্রলীগকে উসকে দেয়। যদিও কিছুক্ষণের জন্য বাঁশ হাতে নিয়ে জুয়েল সেদিন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। শুধু জুয়েল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ছাত্রদল আজকে ক্যাম্পাস ছাড়া বলে ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ।

ছাত্রদল যেন বরিশাল সমিতি

ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের পকেটের লোক দিয়ে ঢাকার সুপার ইউনিট খ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি, ঢাকা কলেজ তেজগাঁও কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল কমিটি গঠন করেন। এখানে মোট ৯টি ইউনিট কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ১৮টি পদের বিপরীতে ১৩টিতে বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রনেতাদের পদায়ন করেন।

কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদল: সভাপতি সাঈদুর রহমান (বরিশাল), সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন (পটুয়াখালী), সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান (বরিশাল)। ১৩ সদস্যের আংশিক কমিটির ৮ জন বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: সভাপতি আসাদুজ্জামান আসলাম (বরিশাল), প্রচার সম্পাদক রুমি (বরিশাল)।

ঢাকা মহানগর উত্তর: সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েল (বরিশাল), সাধারণ সম্পাদক রাসেল বাবু (বরিশাল), সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর বাবু (বরিশাল), সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন (ভোলা)। পরবর্তীতে দপ্তর সম্পাদক ও সহ-দপ্তর ঘোষণা করা হয়, তারমধ্যে দপ্তর সম্পাদকের বাড়িও বরিশাল।

ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল: সভাপতি আবুল কালাম নাসির (বরিশাল), সাধারণ সম্পাদক জুয়েল হাসান রাজ (বরিশাল)। ৭ সদস্য কমিটিতে পরে দপ্তর, সহ-দপ্তর করা হয়েছে, তাদের বাড়ি (ভোলা)।

বাঙলা কলেজ ছাত্রদল: সভাপতি ইব্রাহিম বিপ্লব (পটুয়াখালী), সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন সোহাগ (বরগুনা), সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সর্দার মিলন (বরিশাল)। ১৩ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটির ৯ জনই বৃহত্তর বরিশালের।

ঢাকা কলেজ ছাত্রদল: সাধারণ সম্পাদক মৃধা জুলহাস (পটুয়াখালী)।

তিতুমীর কলেজ ছাত্রদল: সভাপতি আরিফুর রহমান এমদাদ (পিরোজপুর), সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম (গৌরনদী-বরিশাল)।

তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল: সিনিয়র সহ-সভাপতি শামীম পালোয়ান (বরিশাল), সাধারণ সম্পাদক বেলালা খান (বরিশাল)।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল: সভাপতি আবু হোরায়রা (পটুয়াখালী)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়েছে এর অধিকাংশ নেতাকর্মীর বাড়ি বৃহত্তর বরিশাল জেলায়। অনেকে রাজনীতি না করেও পদ পেয়েছেন। এমনকি অনেকে চাকরি করে, এছাড়া এলাকায় থাকে ঢাকার রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। তবুও তারা ঢাকা কলেজ কমিটিতে পদ পেয়েছেন। কারণ তারা কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল ভাইয়ের লোক বলেই পদ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতুমীর কলেজের এক ছাত্রদল নেতা বলেন, তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের কমিটিতে যাদেরকে পদায়ন করা হয়েছে, এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে যাদের কখনো দেখিনি এমন কি চিনিও না। কমিটির ৬০ শতাংশ লোক বরিশালের। তাদের মধ্যে অনেকে চাকরি করে, এমনকি এলাকায় থাকে এমন লোকদেরও পদ দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা শাখা-সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের ডোনার। এজন্য তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে।

>> আরও পড়ুন: ছাত্রদল নেত্রী মানসুরার মামলার আসামি যারা

জানতে চাইলে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রদলের সাধারণ সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, বরিশাল বাড়ি এমন অনেকে শ্রাবণ ভাইয়ের রাজনীতি করে পদ পেয়েছেন, এটা কি আমার দোষ? এছাড়া সদ্যবিদায়ী ছাত্রদলের সভাপতির রাজনীতি করে পদ পেয়েছেন, এটা কি আমার দোষ? যারা যোগ্য তাদেরকে পদ দেওয়া হয়েছে। এখানে কি আমার বলার সুযোগ রয়েছে যে তাদেরকে পদ দেওয়া যাবে না? এছাড়া সদ্যবিদায়ী নেতারা অনেকের জন্য সুপারিশ করেছেন, এজন্য পদ দেওয়া হয়েছে। এর দায় তো আমাদের নয়।

এলাকার ছেলেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রদান ও কমিটি বাণিজ্যর অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, আমাদের কমিটি ঘোষণা হওয়ার পরে ঢাকা সুপার ইউনিটগুলো গঠন করা হয়েছে। সুপার ইউনিটে টাকা দিয়ে পদ পাওয়া যায়- এরকম কথা কখনো শুনি নাই। এছাড়া খুলনা বিভাগের মাত্র একটি ছেলে আমার সাথে রাজনীতি করে।

ঢাকার মধ্যে অধিকাংশ ইউনিটে বরিশাল বাসিন্দাদের পদায়নের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকার শহরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাড়ি হচ্ছে বরিশালে। কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে বরিশাল হিসেবে নয়। কমিটি ঘোষণার পরে জানতে পেরেছি অনেকের আদি বাড়ি বরিশালে। কমিটি দেওয়ার সময় তো বাড়ির হিসাব করা হয় না।

>> আরও পড়ুন: ছাত্রদল ভেবে নিজ দলের কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

এদিকে, গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ছাত্রদল সভাপতির নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তখন বক্তব্য দিতে না পেরে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল গণসমাবেশের সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনুর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে যান। তখন মঞ্চে থাকা প্রধান অতিথি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের এমন আচরণে বিব্রত বোধ করেন।

এর দুদিন পর ১৩ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক প্রতিবাদ সভায় কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। তার এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষুব্ধ হন কৃষকদলের সভাপতিসহ উপস্থিত নেতারা। বিষয়টি নিয়ে কৃষকদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এছাড়া গত আগস্টে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের একটি অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সংগঠনটি ছাত্র সমাজের কাছে ব্যাপক নিন্দিত হয়। আপত্তিকর ওই ভিডিও নিয়ে বিব্রত হয় দলের হাইকমান্ডও।

এমই/জেএম/আইএইচ