জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০৪ এএম
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দলীয় জোটের সঙ্গে জোটে যাওয়া নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় আপত্তি জানিয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চিঠি দিয়েছেন এনসিপির কেন্দ্রীয় ৩০ নেতা। অন্যদিকে জোটে সম্মতি জানিয়ে পাল্টা চিঠি দিয়েছে ১৭০ নেতা। এমন অবস্থায় তরুণদের নিয়ে গড়া নতুন রাজনৈতিক দলটিতে ভাঙনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে দল ঘোষণার দুই দিন আগেই এনসিপি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক আলী আহসান জুনায়েদসহ একাধিক সংগঠক। তাদের নিয়ে গঠন করা হয় আপ বাংলাদেশ। তখন বেশ কিছু নেতাকর্মী জুনায়েদের সঙ্গে চলে যায়। ছাত্রদের দল গঠনের আগ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়েও চলে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা।
এবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে নাখোশ কিছু নেতা। গণমাধ্যমে জোটে যাওয়ার খবর প্রকাশের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় পদত্যাগ করেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, যিনি ফেব্রুয়ারিতে এনসিপি গড়ার শুরু থেকেই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৯ আসন থেকে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে তাসনিম জারা লিখেছেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল একটি রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্ম থেকে সংসদে গিয়ে আমার এলাকার মানুষের ও দেশের সেবা করা। তবে বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের কারণে আমি কোনো নির্দিষ্ট দল বা জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আপনাদের ও দেশের মানুষকে ওয়াদা করেছিলাম যে আপনাদের জন্য এবং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার জন্য আমি লড়ব। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আমি আমার সেই ওয়াদা রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৯ থেকে অংশগ্রহণ করব।’
নব গঠিত এনসিপি নির্বাচনি জোট করার জন্য বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী-দুদলের সঙ্গেই দফায় দফায় আলোচনা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হয়নি। তবে এক সপ্তাহ ধরে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দলটি আসন সমঝোতায় দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হয়ে আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা করে। তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাতে জামায়াত-এনসিপি জোট গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। শনিবার দিনভর এ নিয়ে এনসিপির ভেতরে ও বাইরে নানা আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। এমন সংবাদের পরপরই দলটির মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে ঢাকা-৯ আসনে এনসিপি থেকে নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে তিনি নির্বাচন করার ঘোষণা দেন।
কাছাকাছি সময়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন এনসিপির তিন শীর্ষ নেত্রী। তারা হলেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম সদস্যসচিব নুসরাত তাবাসসুম ও যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. মাহমুদা মিতু।
সামান্তা শারমিন তার পোস্টে বলেছেন, ‘আমরা লড়াই ছাড়ব না। আল্লাহ সহায়।’ আর নুসরাত তাবাসসুম লিখেছেন, ‘নীতির চাইতে রাজনীতি বড় নয়। কমিটমেন্ট ইজ কমিটমেন্ট...।’
অন্যদিকে ডা. মাহমুদা মিতু লিখেছেন, ‘এক পয়সা দিয়েও দেশি ভান ধরা পশ্চিমা গং বিশ্বাস করি না। এর চেয়ে যারা ওপেন বলে-কয়ে পশ্চিমা এজেন্ডার পক্ষ নেয় তাদের স্যালুট।’
একইদিনে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ হোসেনের কাছে চিঠি দেন দলটির ৩০ নেতা।
জামায়াতের সঙ্গে জোটে আপত্তি জানিয়ে নাহিদ ইসলামকে যারা চিঠি দিয়েছেন তাদের মধ্যে দুজন একমত হননি বলে জানা গেছে। ৩০ নেতার পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দায়বদ্ধতা, দলের ঘোষিত মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক নীতির আলোকে জামায়াতের সঙ্গে যেকোনো জোট বা আসন সমঝোতার বিরোধিতা করা হয়। নেতারা দাবি করেন, জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের বিভাজনমূলক রাজনীতি, গুপ্তচরবৃত্তি, অপপ্রচার, ১৯৭১-এর ভূমিকা ও ধর্মভিত্তিক ফ্যাসিবাদের আশঙ্কা এনসিপির আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট করলে দলের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে এবং নতুন প্রজন্মসহ দলীয় সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আস্থাহীনতা তৈরি হবে। তারা মনে করিয়ে দেন, নাহিদ ইসলাম অতীতে ৩০০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠনের সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলেন; মনোনয়ন বিক্রির পর অল্প আসনে জোটে যাওয়া জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলেও মন্তব্য করা হয়।
এরপরই জামায়াতের সঙ্গে জোটে জেতে সম্মতির কথা জানিয়ে শনিবার রাতে এনসিপি আহ্বায়ককে চিঠি দেন ১৭০ জন নেতা। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ হিসেবে দলীয় আদর্শ, লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ কৌশলগত অবস্থানকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে এই মতামত পেশ করছি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে টেকসই করা এবং একটি জনমুখী ও দায়বদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিকভাবে সময়োপযোগী ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।
নেতারা বলেন, সে প্রেক্ষিতে, দলীয় স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে এনসিপি যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সে বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সম্মতি রয়েছে। নির্বাহী কাউন্সিলের সুপারিশের আলোকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কর্তৃক গৃহীত যেকোনো জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের সুস্পষ্ট সমর্থন ও আস্থা রয়েছে।
সম্মতি দেওয়া নেতারা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আপনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে এনসিপি একটি সময়োপযোগী, গ্রহণযোগ্য ও ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যা দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় করবে। এই বিষয়ে আপনি প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এই প্রত্যাশা রেখে আমাদের সম্মতির বিষয়টি সদয় অবগতির জন্য উপস্থাপন করা হলো।
এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব, সারোয়ার তুষার, ড. আতিক মুজাহিদ, জাভেদ রাসীন, আরিফুর রহমান তুহিন, সাইফুল্লাহ হায়দার, আতাউল্লাহ, মাহমুদা মিতু, মাহিন সরকার, এহতেশাম হক, আশিকিন আলম, ডা. আব্দুল আহাদ, সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া, আলী নাসের খান, আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, দিলশানা পারুল, মাহবুব আলম, হাফসা জাহান, ফয়সাল মাহমুদ শান্ত,জুবায়রুল হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনায়েদ, কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস প্রমুখ এই চিঠি দিয়েছেন।
জোট নিয়ে দলের মধ্যে মনোমালিন্য চললেও তা ঠিক হয়ে যাবে জানিয়ে দলটির এক নেতা বলেন, ‘নতুন দল হিসেবে সবার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার এ পথচলায় টানাপড়েন চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ছোটখাটো মনোমালিন্যও দূর হয়ে যাবে।’
টিএই/এমআর