বোরহান উদ্দিন
০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০৩ পিএম
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির রাজনীতিতে দেখা দেয় চাঙ্গাভাব। একচেটিয়া সুযোগে দলের তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। তবে শুরু থেকেই হার্ডলাইনে ছিল বিএনপি। ফলে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি।
বহিষ্কৃতদের মধ্যে কেউ উপজেলা পর্যায়ের, কেউ জেলা বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, অসদাচরণ বা মতবিরোধের কারণে তাদের প্রতি এমন কঠোর মনোভাব ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আবারো তাদের প্রতি দৃষ্টি বাড়াচ্ছে বিএনপি। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠনের কৌশলের অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এসব নেতাকে।
গত পাঁচ দিনে অন্তত ১৩ জন পদধারী নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে দলটি। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বহিষ্কৃতদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই শেষে তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, কুমিল্লার বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কুকেও ডেকে নিয়েছে প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের এমন উদ্যোগকে দলের ভেতরে অনেকেই ‘রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বীকারোক্তি’ হিসেবে দেখছেন। একদিকে নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা, অন্যদিকে তৃণমূলের ভাঙন মেরামত-দুই দিক সামলাতে এখন ‘ঐক্যের পথে হাঁটছে’ বিএনপি।
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, বহিষ্কৃতদের ফেরানোর মাধ্যমে মাঠে স্থবির হয়ে পড়া সাংগঠনিক কাঠামোকে আবারও সচল করার চেষ্টা করছে দলটি। ফলে নির্বাচনের আগে বিএনপি ছন্দে ফিরতে চায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বহিষ্কার নয় এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য মাঠে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। দীর্ঘ সময় রাজপথে থাকা কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো এবং পুরনো-নতুন নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানোই এখন দলের বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বহিষ্কৃতদের ফেরানো কেবল আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি দলের ভবিষ্যৎ টিকে থাকার কৌশলের অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
ধারাবাহিক বহিষ্কার প্রত্যাহার
দলীয় সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একাধিক বহিষ্কৃত নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের আবেদন ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্তগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে।
গত ২৭ অক্টোবর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়-চট্টগ্রাম উত্তর জেলার বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক দিদারুল আলম মিয়াজী ও সৈয়দপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রিয়াদ আরফান সরকার রানার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাদের প্রাথমিক সদস্য পদ পুনর্বহাল করা হয়েছে।

একইভাবে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কৃত আরও সাত নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারা হলেন-ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ফখর উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিবুল উদ্দিন সরকার পাপ্পু, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক রুহুল আমিন দুলাল, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী এবং রংপুর জেলার সাবেক সদস্য মোকাররম হোসেন সুজন ও মো. আলি সরকার।গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) দলের দফতর থেকে জানানো হয়েছে-দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলের নীতি-আদর্শ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের জন্য হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য এবং নবীগঞ্জ পৌর বিএনপির সদস্য ছাবির আহমদ চৌধুরীর প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছিল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে প্রাথমিক সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৩০ অক্টোবর আরেক বিজ্ঞপ্তিতে গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আব্দুল হালিম মোল্লার বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
১ নভেম্বর (শনিবার) সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি মো. মজিবর রহমান লেবু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান রঞ্জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাদের প্রাথমিক সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
বিএনপি দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন ঘিরে এই পুনর্বহালের ধারা আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে একাধিক বহিষ্কৃত নেতা দলের উচ্চপর্যায়ে আবেদন করেছেন এবং তাদের ফেরার বিষয়েও ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে তাদের বিষয়ে আপাতত সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম।
নির্বাচনকে ঘিরে কৌশল
বিএনপির নেতাদের ভাষ্য, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠে শক্তি পুনর্গঠনের অংশ হিসেবেই এই পুনর্বহাল প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন পর দলে ফেরার সুযোগ পাওয়ায় পুরোনো নেতাকর্মীরা আবারও সংগঠনের কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক বাস্তবতা। যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, তারাও বিএনপিরই সন্তান। নির্বাচনে সবাইকে এক ছাতার নিচে আনা এখন অগ্রাধিকার।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পরপরই দল ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন অনেকে নিজের ভুল শুধরে দলে কাজ করতে চান, তাদের বিষয়ে দল যাচাই বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। অবশ্যই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীরা এতে চাঙ্গা হবেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বহিষ্কৃতদের দলে ফেরানো বিএনপির জন্য দ্বিমুখী বার্তা। একদিকে এটি দলীয় ঐক্যের প্রতীক, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতির বাস্তব প্রয়োজনে নেওয়া কৌশল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বহিষ্কৃতদের দলে ফেরানোর ফলে তৃণমূলে বিভেদ বাড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ এসব নেতার অবর্তমানে অন্য গ্রুপ শক্তিশালী হয়েছে। এখন আবার পুরানো নেতারা ফিরে এলে তাদের প্রভাব কমবে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে হাজার হাজার ত্যাগী নেতাকে বাইরে রাখলে তা বিএনপির জন্য বড় সমস্যার তৈরি করবে। এ কারণেই হয়তো এমন কৌশল হাতে নিয়েছে দলটি।’
বিইউ/এমআর