বোরহান উদ্দিন
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০০ পিএম
. ঘোষণার আগেই ফাটল, আট দল নয়, মাঠে নামছে পাঁচ দল
. সরকার ও বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল
. পরিস্থিতি বিবেচনায় কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ভাবনা
. ভাঙনের ছাপ মাঠের কর্মসূচিতে পড়ার আশঙ্কা
চার দফা দাবিতে জামায়াত ইসলামীসহ আট দলের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি শুরুর আগেই ফাটল ধরেছে। দলগুলোর যুগপৎভাবে মাঠে নামার খবর প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে শোরগোল উঠলেও তাতে ছন্দপতন হয়েছে। আট দল নয়, যুগপৎ আন্দোলনে থাকার কথা জানিয়েছে পাঁচ দল। বাকি তিনটি দল আপাতত এই প্রক্রিয়ায় না থাকার কথা জানিয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের বিচারের দাবিকে সামনে রেখে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিলেও, শেষ মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি এতে না থাকার কথা জানিয়েছে। ফলে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকছে কেবল জামায়াতপন্থি ও ইসলামী ধারার শক্তিগুলো।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী চার দফা দাবিতে ভিন্ন জায়গা থেকে যুগপৎ আন্দোলনে নামছে জামায়াত ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ) ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
অভিন্ন এসব দাবি নিয়ে দলগুলো আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করবে। পরে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
দলগুলোর চার দফা দাবি হলো- জুলাই সনদের অবিলম্বে বাস্তবায়ন, জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালু এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ।
এদিকে উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও জুলাই সনদ কার্যকরসহ পাঁচ দফা দাবিতে ইতিমধ্যে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
আরও পড়ুন: যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতের অবস্থান কী?
তবে যুগপৎ আন্দোলনে নামার প্রাক্কালে শোনা যাচ্ছে, দাবি আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি বিএনপিকেও তারা চাপে রাখতে চান। তবে এমন কর্মসূচিকে ঘিরে বিএনপির পক্ষ থেকে খুব একটা প্রতিক্রিয়া নেই বলে জানা গেছে।
বিভ্রান্তি ও ভাঙন
শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়-‘চার দাবিতে আট দল যুগপৎ আন্দোলনে নামছে’। মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। বিরোধী রাজনীতিতে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। কিন্তু বিকেল গড়াতেই এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ফেসবুকে লিখলেন, সংবাদটি ‘মিস লিডিং’। সেই সঙ্গে জানালেন, তাদের অবস্থান সীমিত: কেবল উচ্চকক্ষে পিআর বাস্তবায়ন ও জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে তারা একমত।
অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সোজাসাপ্টা বললেন, এখনই যুগপৎ কর্মসূচি নয়, সময়ের প্রয়োজনে ঐক্যকে শক্তিশালী করাই অগ্রাধিকার। একই সুর এবি পার্টির নেতাদের বক্তব্যেও আলোচনা চলছে, কিন্তু আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত হয়নি।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক বিবৃতিতে বলেন, বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশিত হলেও দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো জোটে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ইসলামপন্থি পাঁচ দলের রোডম্যাপ
অভিন্ন কর্মসূচি গড়তে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ পাঁচটি ইসলামপন্থী দল। তারা প্রথমে ঢাকায় গণসমাবেশ করবে ১৮ সেপ্টেম্বর। পরে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে গণমিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি থাকলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তী ধাপে কঠোর আন্দোলনেও যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে।
তাদের চার দফা দাবি-জুলাই সনদের অবিলম্বে বাস্তবায়ন, জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালু এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ।
নেতারা বলছেন, বিএনপিকে বাইরে রেখেই এই ঐক্য গড়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে, জামায়াতসহ ইসলামী ঘরানার শক্তিগুলো বিএনপিকে চাপের মুখে রাখতেই এই যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
তিন দলের না থাকা নিয়ে নানা গুঞ্জন
শুরুর ঘোষণায় আট দলের নাম এলেও শেষ পর্যন্ত তিন দলের সরে দাঁড়ানো—এটা নিছক সংখ্যার হেরফের নয়, বরং বার্তা বহন করে যে বিরোধী রাজনীতির ভেতরে আস্থার সংকট এখনও কাটেনি। ইসলামী ঘরানার পাঁচ দল মিলে কর্মসূচি শুরু করলেও বিএনপি বা গণঅধিকার পরিষদ–এবি পার্টির মতো নতুন প্রজন্মের দলগুলোকে বাইরে রেখে কতদূর যাওয়া যাবে, তা নিয়েই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
রাজনৈতিক মহল বলছে, ঘোষণার আগেই ভাঙন ধরা পড়ায় এই যুগপৎ আন্দোলন শুরুতেই দুর্বল হয়ে গেল। আর সেই দুর্বলতার ছাপ পড়তে পারে মাঠের কর্মসূচিতে। সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর চাপ তৈরির বদলে এই উদ্যোগকে ঘিরে এখন উল্টো বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোনো দল কিন্তু বলেনি তারা এই যুগপৎ আন্দোলনে নেই। সবাইকে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল। তাদের সেই আলোচনা হয়নি। আমরা আশা করি তারাও আমাদের দাবির সঙ্গে একমত। আমরা সবাই সবার পাশে আছি। পাশে থাকব। তারাও হয়তো সুবিধামতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন।’
যুগপৎ আন্দোলন জামায়াত নেতৃত্ব দিচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো দলের লিডিং দেওয়ার কিছু নেই। সুযোগও নেই। সবাই সমান। সবার তো দাবির প্রতি একাত্মতা আছে।
যুগপৎ আন্দোলনে না থাকা দলগুলো কী বলছে
আট দল মিলে যুগপদৎ আন্দোলনে যাচ্ছে এমন খবর প্রকাশের পর শনিবার এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াজোঁপ্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, এনসিপি এখনও কোনো জোট বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ কথা জানান তিনি।
পরে তিনি এ বিষয়ে বলেন, ৪ দাবিতে আট দলের যুগপৎ কর্মসূচির যে নিউজ হয়েছে, তা মিস লিডিং। যেভাবে বলা হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলন বা কর্মসূচি হবে; ঠিক সেভাবে নয়। আমরা দুই-তিনটা বিষয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে একমত হয়েছি। কিন্তু এই নয়, এখনই আমরা আন্দোলনে যাচ্ছি। আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু জামায়াতসহ অন্যরা ঘনভোট কিংবা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। এনসিপি নিজস্ব সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষৎ কর্মসূচি দেবে।
আরও পড়ুন: যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির অর্জন কী?
আর গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। কারও সঙ্গে খারাপ চাই না। আমাদের সব দলের সঙ্গেই কথা হচ্ছে। এসব অনানুষ্ঠানিক। কিন্তু আট দল মিলে, চার দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের যে কথা বলা হচ্ছে এমন কোনো ধারণা আমাদের নেই।
রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা জুলাই সনদ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন চাই। আমাদের আসলে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য কীভাবে আরও মজবুত করা যায় সেজন্য কাজ করছি। আমাদের মধ্যে কোনো কারণে বিভেদ দেখা দিলে ফ্যাসিবাদ সুযোগ নেবে। সেটা আমরা দিতে পারি না।’
এখনই কোনো রাজনৈতিক জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি আমার বাংলাদেশ পার্টিও (এবি পার্টি)। এক বিবৃতিতে দলটি বলছে, কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘চার দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচিতে যাচ্ছে জামায়াত, এনসিপিসহ আট দল’ সংক্রান্ত যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন এবি পার্টির চেয়ারমান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
বিইউ/এমআর